শেখ মোজাহার।
আর কত রক্ত ঝরবে গ্রামে?
লাউদোহার কৈলাসপুরে বহু বাসিন্দার প্রশ্ন এখন এটাই। বেআইনি কয়লা কারবারের দখল নিয়ে নানা গোষ্ঠীর কোন্দলে গত এক দশকে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে এই গ্রাম। খুন-জখম যেন লেগেই রয়েছে। ইদের সকালে এক সময়ের কয়লা মাফিয়া শেখ আমিনের পাশাপাশি এলাকায় নিরীহ বলে পরিচিত শেখ মোজাহার হোসেনের গুলিতে খুন হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছে গ্রামবাসীদের মধ্যে।
পুলিশ ও স্থানীয় নানা সূত্রের দাবি, কৈলাসপুরের বাসিন্দা শেখ সেলিমের হাত ধরেই এলাকায় বেআইনি কয়লার কারবারের রমরমা হয়েছিল। অল্প বয়সে ইসিএলের কর্মীদের কাছে সস্তায় ‘ডোমেস্টিক কোল’ কিনে কারবার শুরু। পরে মাধাইবনি, ঝাঁঝরা কোলিয়ারি থেকে সেলিমের দলবল দিনে কয়েকশো টন করে কয়লা লুঠ করত বলে অভিযোগ। ২০০৪ নাগাদ সেলিমের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন তাঁরই এক সময়ের ডান হাত শেখ আমিন। শুরু হয় এলাকা দখল নিয়ে দু’পক্ষের বোমা-গুলির লড়াই। সেই শুরু। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে খুন হয়ে যান সিপিএমের লাউদোহা লোকাল কমিটির সদস্য তথা ওই গ্রামের বাসিন্দা শেখ ফারুখ হোসেন ও তাঁর সঙ্গী, জগন্নাথপুরের সুধীর বাউড়ি।
সেলিম তখন গ্রেফতার হন। তিনি অবশ্য তত দিনে মাধাইগঞ্জে বিশাল বাড়ি, কাঠগোলা, পেট্রোল পাম্প তৈরি করে ফেলেছেন। এর পরে ভাই শেখ জাহাঙ্গির-সহ সেলিমের দলের একাধিক লোকজনকে খুনের অভিযোগ ওঠে আমিনের দলবলের বিরুদ্ধে। ২০১১-র বিধানসভা ভোটের আগে লাগোয়া আমদহি গ্রামে দুই তৃণমূল কর্মীকে খুনেও অভিযুক্ত হন আমিন-সহ কুড়ি জন। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। সে বছরই জেল থেকে ছাড়া পান সেলিম। ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর বাড়ির কাছে গুলিতে খুন হয়ে যান তিনি। সে বছরই ৩১ ডিসেম্বর গ্রামে আবার খুন-পাল্টা খুনের ঘটনা ঘটে।
২০১৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পান আমিন। মঙ্গলবার ইদের সকালে নমাজ শেষে বেরিয়ে আসার সময়ে ইদগাহের সামনে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান তিনি। তখনই গুলি লাগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাশ গ্রামের যুবক শেখ মোজাহার হোসেনের মাথায়। বুধবার রাতে দুর্গাপুরের বিধাননগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান। অভিযোগ, এক সময়ে আমিনের সঙ্গী শেখ শাজাহান ও তার দলবল এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।
মোজাহারের মৃত্যুর পরেই থমথমে হয়ে গিয়েছে গোটা গ্রাম। বাসিন্দারা জানান, গ্রামের কোনও নিরীহ যুবক এ ভাবে দু’টি গোষ্ঠীর লড়াইয়ের বলি হওয়ার ঘটনা এলাকায় প্রথম। মোজাহারের বাবা শেখ কাদের চাষবাস করে মোজাহারকে পড়াশোনা করিয়েছিলেন। গৃহ শিক্ষকতা করতেন মোজাহার। আরতি গ্রামে বিয়ে হয়েছিল কয়েক মাস আগে। স্ত্রী তসলিমা সন্তানসম্ভবা। স্থানীয় বাসিন্দা শেখ হালিম বলেন, ‘‘দশ বছর ধরে আগুন জ্বলছে। এমন ঘটনা মানতে পারছি না।’’ দুঃসংবাদ শোনার পর থেকে চোখে জল লাউদোহা কেটিবি ইনস্টিটিউশনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নার্গিস খাতুন, দ্বাদশ শ্রেণির হাসিয়া খাতুনদের। প্রিয় স্যারের মারা যাওয়ার খবর বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা।
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা শেখ বদরুদ্দিনের আফশোস, ‘‘আমাদের গ্রামে শান্তির পরিবেশ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে সব বদলে গেল!’’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আর এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘গ্রামে অবিশ্বাসের চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। আমরা পুরনো কৈলাসপুর ফিরে পেতে চাই।’’ বেআইনি কয়লার কারবার একেবারে বন্ধ করতে না পারলে অশান্তি এড়ানো যাবে না, এমনটাই মনে করছেন গ্রামের ১৮২টি পরিবারের অধিকাংশ মানুষজন।
পুলিশের ভূমিকা নিয়েও বাসিন্দারা ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন বাসিন্দারা। এত দিন ধরে অশান্তি চললেও স্থায়ী ভাবে তা বন্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে তাঁদের দাবি। গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, কোনও ঘটনা ঘটলে পুলিশি তৎপরতা দেখা যা গ্রামে। কিন্তু তার পরে আবার আগের পরিস্থিতি ফিরে আসে। এই ঘটনার পরে যেমন এলাকায় একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনার অবশ্য আশ্বাস, এলাকায় শান্তি ফেরাতে সব রকম পদক্ষেপ করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy