Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

চাহিদা ইংরেজির, ধুঁকছে বাংলা মাধ্যম স্কুল

দু-তিন বছর আগেও শহরের স্কুল-মানচিত্রটা এমন ছিল না। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল হাতেগোনা। বেশির ভাগ অভিভাবকেরাই বাংলা মাধ্যম স্কুল বেছে নিতেন। বিশেষত সাধারণ ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা মাধ্যমই আদর্শ বলে মনে করতেন অভিভাবকেরা। অথচ তারপরের কয়েকটা বছরেই আমুল বদলে গিয়েছে ছবিটা। এক দিকে বহু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠেছে শহরে। আর এক দিকে ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে বহু বাংলা মাধ্যম স্কুল।

শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০১:০৩
Share: Save:

দু-তিন বছর আগেও শহরের স্কুল-মানচিত্রটা এমন ছিল না। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল হাতেগোনা। বেশির ভাগ অভিভাবকেরাই বাংলা মাধ্যম স্কুল বেছে নিতেন। বিশেষত সাধারণ ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা মাধ্যমই আদর্শ বলে মনে করতেন অভিভাবকেরা। অথচ তারপরের কয়েকটা বছরেই আমুল বদলে গিয়েছে ছবিটা। এক দিকে বহু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠেছে শহরে। আর এক দিকে ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে বহু বাংলা মাধ্যম স্কুল।
বর্ধমান শহরে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ অনুমোদিত স্কুল রয়েছে ৩০টি। এ ছাড়াও ১৪টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। জেলা স্কুল পরিদর্শক দফতরের হিসেবে, ওই ৩০টির মধ্যে অন্তত ১০টি স্কুলই পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। ফি বছর কমছে পড়ুয়াদের সংখ্যা। পরিস্থিতি এমনই চললে আগামী দু-তিন বছরে চার থেকে পাঁচটি স্কুল উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তাঁদের আশঙ্কা। ইতিমধ্যেই গত বছর ছাত্রীর অভাবে হরিজন বালিকা বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হাল খারাপ উচ্চ প্রাথমিক স্কুলগুলিরও। সরাসরি স্কুল বন্ধের কারণ বলতে না চাইলেও জেলা স্কুল পরিদর্শক বলেন, ‘‘৬টি আপার প্রাইমারি স্কুলকে তুলে দেওয়ার জন্য শিক্ষা দফতরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।”

উল্টো দিকে, এ শহরে পঞ্চাশ বছরের পুরনো সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল তো ছিলই গত দু’তিন বছরে আরও বেশ কয়েকটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গড়ে উঠেছে। ওই সব স্কুলের শিক্ষকদের দাবি, তিন বছরে শহরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা ৪ থেকে ১০-এ পৌঁছেছে। যাদের বেশির ভাগ আইসিএসই বোর্ডের, একটি সিবিএসই বোর্ডের।ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়া বাড়ছে বলে সেন্ট জেভিয়ার্স স্নাতক স্তরের কলেজও খুলেছে শহরে।

কিন্তু বাং‌লা মাধ্যম স্কুলের এই অস্তিত্ব সঙ্কটের কারণ কী? বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমস্যার শুরু বছর পাঁচেক আগেই। তখন থেকেই তথাকথিত ভাল পড়ুয়ারা পঞ্চম শ্রেণিতে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। আর এখন তো মাঝারি স্তরের পড়ুয়ারাও ইংলিশ মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে। ফলে নামী স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা এক থাকলেও টান পড়ছে সাধারণ স্কুলে। ছাত্রের অভাবে ধুঁকতে থাকা একটি স্কুলের এক শিক্ষকের দাবি, “মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা যে সব স্কুলে ভর্তি হত, সেই সব স্কুলগুলি ধুঁকতে শুরু করেছে।” জানা গিয়েছে, এ বছর বেশ কয়েকটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ২৫ জনের বেশি পড়ুয়া ভর্তিই হয়নি। জেলা শিক্ষা দফতরের দাবি, ওই সব স্কুলে কোথাও পড়ুয়ার সংখ্যা ১৯১ তো কোথাও মেরেকেটে ৪৬৯ জন। শহরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দীপা কুণ্ডু মণ্ডল বলেন, “গত দু’তিন বছরে পরিস্থিতিটা ঘোরালো হয়ে উঠছে। প্রতি বছরই পড়ুয়া সংখ্যা কমছে। মধ্যবিত্ত বাড়ির পড়ুয়ারাওইংরেজি মাধ্যমে ঝুঁকছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নানা রকম প্রচেষ্টা করা হলেও পড়ুয়ারা এ ধরনের স্কুলে আসতে চাইছে না।” আরও এক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নমিতা ভট্টাচার্যেরও দাবি, ‘‘মোটামুটি ভাবে নামী স্কুলের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ ইংরেজি মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। আর আমাদের মতো স্কুলের পড়ুয়ারা ওই সব নামী স্কুলে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে গিয়েছে।”

এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অভিভাবকদের অভিযোগ, মাধ্যমিক স্তরে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষকরা পড়ুয়াদের আর নতুন কিছু শেখাতে পারছেন না। এ ছাড়া পড়াশোনার মান কমছে এবং পড়ুয়াদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার অভাব দেখা দিচ্ছে বলেও তাঁদের দাবি। সর্বোপরি, ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখানোর উচ্চাকাঙ্খাতেই ইংরাজি মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন অভিভাবকরা। নীলপুর এলাকার অসিত মুখোপাধ্যায় কিংবা নতুন পল্লির সায়ন্তিকা রায়চৌধুরীরা যেমন বলেন, “বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর খরচ অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েকে ভাল পড়াব এই আশায় ইংরেজি মাধ্যমে দিয়েছি।’’ তাঁদের দাবি, ‘‘বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষকরা ক্লাসে অনেক বেশি মনযোগ দিয়ে পড়ান।” আবার রামানুজ মিশ্র কিংবা রজতাভ মল্লিকের মতো অভিভাবকরা মনে করেন, “মাধ্যমিক স্তরের একজন পড়ুয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাসগুলো মন দিয়ে করলে কোচিংয়ের দরকার পড়ে না। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে এক একজন পড়ুয়ার ৭-৮টা করে গৃহশিক্ষক। হিসাব করলে দেখা যাবে, গড়পড়তা একই খরচ হচ্ছে।’’

আর একটি স্কুলের খুদেরা ব্যস্ত খেলাধুলোয়।

ইংরেজি মাধ্যমের চাহিদার কথা মানছেন শিক্ষকেরাও। বর্ধমান শহরে এই মূহুর্তে মোটামুটি ভাবে ১০টি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। পড়ুয়া সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অথচ বছর তিনেক আগেও এই সংখ্যা ছিল মেরেকেটে দু-তিন হাজার। নবাবহাটের কাছে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অধ্যক্ষ সুকুমার মহাপাত্র বলেন, “শহরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এমনকী বাংলা মাধ্যমের শিক্ষক দম্পতিও আমাদের স্কুলে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘অভিভাবকদের চাহিদা বাংলা মাধ্যম পূরণ করতে পারছে না।’’ নীলপুর এলাকার পঞ্চাশ বছরের পুরনো একটি স্কুলের অধ্যক্ষ জি পল অ্যারোকিয়ামও বলেন, “গত পাঁচ বছর ধরে চাপ বাড়তে শুরু করেছে। আমারা এখন পড়ুয়া নিতে পারছি না। মনে রাখতে হবে, ৭৫ শতাংশ পড়ুয়াই কিন্তু বাঙালি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘৯৭ জনকে নিয়ে কলেজ শুরু করেছিলাম। এ বছর আমাদের পড়ুয়া ২৫০ ছাড়িয়ে যাবে।”

তাহলে উপায়? শিক্ষাবিদদের মতে, মাধ্যমিক পর্ষদ অনুমোদিত স্কুলগুলিতে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি চালু না করলে সত্যি করেই ‘অস্তিত্ব সঙ্কটে’ পড়বে।

ছবি: উদিত সিংহ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE