Advertisement
E-Paper

চিহ্ন বদলে পাচার হয় কয়লা-ট্রাক

প্রশ্ন যেখানে, প্রথমত— অবৈধ খাদান থেকে তোলা কয়লা, মাফিয়ারা কোথায় বিক্রি করছে? কী ভাবে পুলিশের নজর এড়িয়ে দিনের পর দিন এ কাজ চলছে?

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০২:৩০
সালানপুর থেকে চলছে অবৈধ কয়লা পাচার। ছবি: পাপন চৌধুরী

সালানপুর থেকে চলছে অবৈধ কয়লা পাচার। ছবি: পাপন চৌধুরী

বৈধ ব্যবসার পাশাপাশি রমরমিয়ে চলছে অবৈধ ব্যবসাও। প্রতিদিনই টন-টন কয়লা পাচার করে কোটিপতি হচ্ছে মাফিয়ারা। এই কয়লা চুরি রুখতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দিয়েছেন।

তবে অনেকের অভিযোগ, সহজ পথে আয় করা এই কালো টাকার কিছু ভাগ যায় এলাকার প্রশাসনিক আধিকারিক একাংশ থেকে কিছু রাজনৈতিক নেতার পকেটে। ফলে বাড়তি আয় হচ্ছে কিছু রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক আধিকারিকের। আর এ ভাবেই লুঠ হয়ে যাচ্ছে দেশের সম্পদ। এক কথায়, এর পিছনে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে।

প্রশ্ন যেখানে, প্রথমত— অবৈধ খাদান থেকে তোলা কয়লা, মাফিয়ারা কোথায় বিক্রি করছে? কী ভাবে পুলিশের নজর এড়িয়ে দিনের পর দিন এ কাজ চলছে?

সিন্ডিকেটের প্যাড। পাচারের সময় বদলে যায় এই চিহ্ন।

প্রায় তিন দশক ধরে ইসিএল আধিকারিকেরা খনি অঞ্চল জুড়ে এই একই ছবি দেখে চলেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, খনি এলাকায় বহু ‘কয়লা সহায়ক’ শিল্প গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— ইস্পাত শিল্পে ব্যবহৃত তাপনিরোধক ইট তৈরির কারখানা, নির্মাণ শিল্পে ব্যবহৃত সাধারণ ইটভাটা, গৃহস্থের কাজে ব্যবহৃত গুল কারখানা, বেসরকারি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা ও ছোট ইস্পাত কারখানা। এই প্রত্যেকটি শিল্প সংস্থাতেই কাঁচা কয়লা অত্যন্ত জরুরি উপাদান। ইসিএলের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, এই সংস্থাগুলি চাইলেই তাদের প্রয়োজনীয় কয়লা ইসিএলের কাছ থেকে কিনতে পারে। এ জন্য অবশ্য সংস্থার মালিকদের টন প্রতি ৩৫০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত দাম দিয়ে ইসিএলের বিপণন দফতরে আবেদন করলেই কয়লা মিলবে।

ইসিএলের দাবি, অথচ খনি এলাকায় অবস্থিত কয়েকশো কারখানা, হাজার খানেক ইটভাটা, গুল কারখানা ও শতাধিক ছোট-বড় ইস্পাত ও স্পঞ্জ কারখানার বেশির ভাগই বৈধ ভাবে কয়লা না কিনে মাফিয়াদের থেকে টন পিছু দেড় থেকে দু’হাজার টাকায় নিচ্ছে। ইসিএলর এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এই কারখানাগুলিই অবৈধ খাদানের কয়লা বিক্রির মূল বাজার।’’ ইসিএল কর্তাদের দাবি, তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এই বিস্তীর্ণ খনি ও শিল্পাঞ্চলে বসবাসকারি কয়েক লক্ষ বাসিন্দা এখনও গৃহস্থালির কাজে কয়লা ব্যবহার করেন। আবার খনি ও শিল্পাঞ্চলের কোথাও কয়লা বিক্রির মুক্ত বাজারও নেই।

দ্বিতীয়ত— এই কয়েক লক্ষ বাসিন্দা কয়লা পাচ্ছেন কোথা থেকে? আধিকারিকদের দাবি, গৃহস্থেরাও চুরির কয়লা ব্যবহার করছেন। জানা গিয়েছে, অবৈধ খাদান থেকে তোলা কয়লা প্রথমে জঙ্গল ঘেরা জায়গায় মজুত করা হয়। তারপরে সেই কয়লা পুড়িয়ে গৃহস্থের ব্যবহার উপযোগী করে চড়া দরে বিক্রি করা হয়। কুলটির মিঠানি লাগোয়া রাধানগর রোড ও ইস্কো বাইপাস রোড অঞ্চল, রূপনারায়ণপুরের কানগুই এলাকা, সালানপুরের বনজেমাহারি, ডাবরখনি, জামুড়িয়ার নিঘা অঞ্চলে গেলেই দেখা যাবে, জঙ্গল ঘেরা বিঘার পর বিঘা জমিতে প্রচুর পরিমাণে মজুত কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। শুধুমাত্র এই খনি শিল্পাঞ্চলেই অবৈধ খাদানের কয়লার একমাত্র বাজার নয়। সড়ক পথ ধরে এই কয়লা নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতা, হুগলি, মুর্শিদাবাদ-সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। আবার বারানসী পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে কয়লা পাচার করছে মাফিয়ারা বলে জানান, ইসিএল কর্তারা।

রাজ্য বা জাতীয় সড়ক ধরে কখনও রাতে, কখনও দিনের আলোয় একের পর এক থানা এলাকা পার হয়ে যায় চুরির কয়লা। কী ভাবে? সেই প্রশ্নও তুলেছেন ক্ষোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার দুর্গাপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে এই নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার-সহ রাজ্য পুলিশের ডিজিকে কড়া নজরদারি চালানোর নির্দেশও দিয়েছেন।

তৃতীয়ত— যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে, তা কেমন কাজ করে? পুলিশেরই এক কর্তা জানান, কয়লা মাফিয়ারা নিজেদের মধ্যে একটি ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তুলেছে। কয়লা পাচারের সময় সিন্ডিকেটের তরফে প্রত্যেক ট্রাক চালকের হাতে একটি করে ‘প্যাডের’ কাগজ দেওয়া হয়। সড়ক পথে যাওয়ার সময় কয়লা বোঝাই ট্রাক আটকালে, পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীকে ওই কাগজ দেখালেই ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হয়। এই প্যাডের কাগজ সিন্ডিকেটেরই দেওয়া, তা বোঝাতে তাতে এক বিশেষ চিহ্ন থাকে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিদিন ওই চিহ্ন বদলও করা হয়। যেমন ঠাকুর, জীব-যন্তু বা ফলের ছবি দেওয়া হয়। এই বিষয়টি একমাত্র সিন্ডিকেটের সদস্য, ট্রাক চালক ও রাস্তা পাহারায় দায়িত্বে থাকা পুলিশকর্মীরা জানতে পারেন। কোন দিন কোন চিহ্ন থাকবে, তা আগেই রাস্তা পাহারার দায়িত্বে থাকা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশও চিহ্ন মিলিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। এই ভাবেই দিনের পর দিন সড়ক পথে পাচার হচ্ছে অবৈধ কয়লা বোঝাই ট্রাক।

কয়লা চুরি ও পাচার রোখা প্রসঙ্গে ইসিএলের কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায় বলেন, ‘‘আমাদের তরফে নিরাপত্তা বাড়ানো হচ্ছে। চুরির ঘটনা ঘটলে আমরা পুলিশকে লিখিত অভিযোগ করি।’’ পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা। তবে তিনি বলেন, ‘‘কয়লা চুরি রুখতে ও বেআইনি খাদান বন্ধ করতে ইসিএলের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসব। সড়ক পথ-সহ এলকায় নজরদারি চালাতে আমরা সিসি ক্যামেরা বসিয়েছি। আরও বসানো হবে।’’

(চলবে)

Coal smuggling Asansol আসানসোল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy