আঠারো বছর আগে এমনই এক ডিসেম্বরের সকাল। বার্নপুরে শিল্পাঞ্চলে পা রেখে উজ্জ্বল অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তা বাস্তবায়িতও করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই প্রায় তিন দশকের রুগ্ণ দশা কাটিয়ে ‘নবজন্ম’ হয় বার্নপুর ইস্কো কারখানার। আর এক ডিসেম্বরে তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ শিল্পাঞ্চল।
২০০৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর ওই প্রকল্পের শিলান্যাস করতে বার্নপুরে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কারখানার বার্নপুর রিভারসাইড এয়ারস্ট্রিপে সে দিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই এয়ারস্ট্রিপে পর পর তিনটি সামরিক হেলিকপ্টার অবতরণ করল। দ্বিতীয়টি থেকে নেমে আসেন তিনি। হেঁটেই মঞ্চে ওঠেন। মঞ্চে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। মনমোহন মঞ্চে উঠতেই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানান অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিল্পাঞ্চলবাসী। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের বোতাম টিপে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তিনি। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, কারখানার আধুনিকীকরণের জন্য কেন্দ্র প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। কারখানার সঙ্গেই আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠবে বহু ইস্পাত অনুসারী শিল্প। উপকৃত হবেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগপতিরা। চাঙ্গা হবে পুরো শিল্পাঞ্চলের অর্থনীতি। বড়দিনের প্রাক্ মুহূর্তে তিনি কার্যত ‘কল্পতরু’ হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তৃতার ছত্রে-ছত্রে সে দিন ছিল শিল্পাঞ্চলের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করানোর আশ্বাসবাণী।
সেই আশ্বাস বৃথা হয়নি। প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ২০১৭ সালে সম্পন্ন হল ইস্কোর নতুন প্রকল্প। যা দেশের সর্ববৃহৎ আধুনিক ইস্পাত প্রকল্পের মর্যাদা পেয়েছে। প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতি বছর লাভের মুখ দেখায় ও এলাকার অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায়, ফের ৩৫ হাজার কোটি টাকার নতুন একটি ইস্পাত প্রকল্প গড়ে তুলতে চলেছে ইস্পাত মন্ত্রক।
মনমোহনের প্রয়াণে তাই শিল্পাঞ্চল বেদনাতুর। প্রকল্প গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণ থেকে জমিদাতাদের অর্থ প্রদান ও প্রাথমিক নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন সংস্থার প্রাক্তন আধিকারিক মিহির রাউথ। শুক্রবার তিনি জানান, বার্নপুরে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে সচিবদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, কারখানা লাগোয়া অঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা কেমন, কী ভাবে দিনযাপন হয়, কারখানার উপরে তাঁরা কতটা নির্ভর করেন। কারখানার দিন ফিরলে আশপাশের বসতি এলাকাগুলির সামাজিক উন্নয়নের পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। মিহির বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আসার আগে পর্যন্ত যতটা কঠিন মনে হয়েছিল, ঠিক ততটাই সহজ হয়েছিল তিনি উপস্থিত হওয়ার পরে। এতটাই ভদ্র ও নম্র ছিলেন তিনি।”
মনমোহন প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে আসানসোলের সাংসদ ছিলেন বংশগোপাল চৌধুরী। তিনি জানান, ইস্কোর আধুনিকীকরণ প্রকল্পের শিলান্যাসের পরে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের হাত চেপে ধরে আশা প্রকাশ করেছিলেন, শিল্প মনোভাবাপন্ন বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে ইস্কো সুফল পাবে, এটা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। বংশগোপাল বলেন, “ধস কবলিত অঞ্চল ও বাসিন্দাদের পুনর্বাসনেও তাঁর আগ্রহ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তিনি আর সেই সুযোগ পাননি।”
এ দিন সকালে বার্নপুরের আইএনটিইউসি ভবনে পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। শোকপ্রস্তাব পাঠ করা হয়। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক হরজিৎ সিংহ বলেন, “তাঁর ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায় বার্নপুর ইস্পাত কারখানার পুনর্জন্মের কথা চিরকাল মনে রাখবে শিল্পাঞ্চল।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)