বাজনার ব্যান্ডের দল, ফুলের জোগানদার থেকে শুরু করে দশর্কমার দোকানদার, সকলেরেই এক দাবি— নগদে টাকা দিতে হবে। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় অর্থসচিবের ঘোষণার পরেও টাকা মিলছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে। প্রায় সব ব্যাঙ্কেরই এক রা, ‘টাকা মিলবে না। নির্দেশিকা হাতে আসেনি।’ এই পরিস্থিতিতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকেরা পড়েছেন আতান্তরে।
সার-বীজের ব্যবসায়ী কাটোয়ার আখড়ার বাসিন্দা প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়ে রবিবার রাত ফুরলেই। বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি বিয়ের কার্ড ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে কাটোয়া-দাঁইহাটের ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে ঘুরছেন। কিন্তু নগদ পাননি হাতে। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সকলেই নগদে টাকা চাইছেন। অথচ ব্যাঙ্ক টাকা দিচ্ছে না। এখনও হাজার খানেকই জোগাড় করতে পারিনি।’’
অথচ বৃহস্পতিবারই কেন্দ্রীয় অর্থসচিব শক্তিকান্ত দাস ঘোষণা করেন, বিয়ের জন্য আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা তোলা যাবে। তবে তার জন্য গ্রাহককে প্রমাণপত্র হিসেবে বিয়ের কার্ড, প্যান কার্ড, কেওয়াইসি-র কাগজপত্র ব্যাঙ্কে দেখাতে হবে। এই নির্দেশের পরেও টাকা তো দূরঅস্ত, আবেদনটুকুও জমা নেওয়া হচ্ছে না বলে জানান দাঁইহাটের পরেশ ঘোষ। তবে শনিবার বিডিও-র হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দাঁইহাট শাখা অবশ্য টাকা তোলার আবেদনপত্র জমা নিয়েছে। তবে আবেদনপত্র জমা নিলেও চিন্তা কাটছে না অভিভাবকদের। চরপাতাইহাটের উত্তম ভট্টাচার্য যেমন বলেন, ‘‘আবেদনপত্র নিয়েই কী হবে। টাকা পেলেও তো সোমবারের আগে নয়। আর ওই দিনই বাড়িতে বিয়ে। সকলের টাকা মেটাব কী ভাবে?’’ দাঁইহাটের ওই ব্যাঙ্কের এক কর্তা শনিবার জানান, এ দিন কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার ও সেভিংস অ্যাকাউন্টে ২৪ হাজার টাকার বেশি এ দিন দেওয়া সম্ভব হয়নি।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা শুনে খানিক স্বস্তি পেয়েছিলেন দুর্গাপুরের সগড়ভাঙার বছর ৬৪-র গোপাল ঘোষ। নির্দেশ শুনে শুক্রবার সকাল সকাল ব্যাঙ্কে গিয়েও টাকা পাননি গোপালবাবু। শনিবারও তিনি ব্যাঙ্কে ফোন করেছিলেন। কিন্তু গোপালবাবু জানান, ‘‘এ দিনও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানান, নির্দেশিকা ব্যাঙ্কে আসেনি। তাই টাকা দেওয়া হবে না।’’ এই পরিস্থিতিতে সোমবার, ছেলের বিয়ের দিনেও ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই বলে জানান তিনি। শুধু তাই নয়, তাঁর অভিযোগ, ব্যাঙ্কের দুর্গাপুর বাজারের সেন মার্কেটের শাখায় সেভিংস অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অথচ ওই শাখা থেকে বারবার মেন গেট এলাকায় প্রধান শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।
একই রকম আতান্তরে পড়েছেন বিধাননগরের সমীর বসুও। শুক্রবার থেকেই তিনি মেয়ের বিয়ের কার্ড নিয়ে তিনি হত্যে দিচ্ছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সিটি সেন্টার শাখায়। কিন্তু লাভ হয়নি। শনিবার তিনি বলেন, ‘‘দু-তিন দিন পরে ফের যাব ব্যাঙ্কে, দেখি তত দিনে নির্দেশিকা ব্যাঙ্কে আসে কি না!’’
তবে এই সমস্যা প্রধানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতেই হচ্ছে বলে জানান কাটোয়ার বাসিন্দারা। বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কাটোয়া শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখান থেকে টাকা মিলছে। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের কাটোয়া শাখার ম্যানেজার প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আমাদের ব্যাঙ্কে যাঁদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তাঁরাই একমাত্র টাকা পাচ্ছেন।’’ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এমন হাল কেন? সূত্রের খবর, লিখিত ভাবে না এলেও এই পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে নির্দেশমতো কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তার ব্যাতিক্রম কেন? একটি সূত্রের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে পর্যপ্ত নগদ মজুত না থাকাতেই এই বিপত্তি ঘটছে। তবে এর পরেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাটোয়া শাখার এক ম্যানেজারের আশ্বাস, ‘‘সোমবার হয়তো টাকা দিতে পারব।’’
এই আশ্বাসে ভরসা করেই আপাতত রবিবারের রাতটা কাটাতে হচ্ছে পাত্র-পাত্রীদের অভিভাবকদের। তাঁদের এই অসহায়তা নিয়ে গানও বেঁধে ফেলেছেন বর্ধমানের স্বপন বাউল। কাটোয়ার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে চলেছেন— ‘‘টাকা ছাড়া বিয়ে হবে না/ মেয়ের বাবার মাথায় হাত/ ব্যাঙ্কের দরজা ছাড়ে না।’’