অগ্রদ্বীপে পাড় ভেঙে এগিয়েছে ভাগীরথী। নিজস্ব চিত্র
নতুন আটচালায় সপরিবারে দেবী দুর্গা, ছবি দেখাচ্ছিলেন ইছাময়ী ঘোষ। মলিন সাদা রঙের সুতির কাপড়ে ছবিটা মুছে তিনি বলেন, ‘‘এই মন্দিরটা আর নেই। হঠাৎ এক রাতে সব শেষ হয়ে গেল। মন্দিরের সঙ্গে আমার বাড়িটাও গিলে নিল নদী।’’ আঙুল উঁচিয়ে তিনি দেখান, ভাগীরথীর কাছে কোন দিকে ছিল সেই মন্দির। সেখানে পুজোয় কত আনন্দ হত, বলে চলেন তিনি।
ইছাময়ীদেবীর গ্রাম অগ্রদ্বীপ ভাঙনের জন্য পরিচিত। পূর্ব বর্ধমান জেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই গ্রাম। শুধু অগ্রদ্বীপ নয়, ভাগীরথীর ভাঙনে অতিষ্ঠ কাটোয়া-কালনার বিস্তীর্ণ এলাকা। তেমনই আবার জামালপুর ও গলসির নানা গ্রামের বাসিন্দারা সমস্যায় দামোদরের ভাঙনে।
পূর্বস্থলীর কুঠুরিয়া গ্রামের ফুলেশ্বরী সর্দার বলছিলেন, “গ্রাম থেকে দু’মাইল দূরে পুজো হত। সেই জায়গা গঙ্গা খেয়ে নিয়েছে।’’ পুজোয় এতটা পথ যেতে হত? ফুলেশ্বরীর জবাব, ‘‘আমরাও তো ওখানেই ছিলাম। ভাঙনের জন্য পালিয়ে এসেছি।’’ একই হাল অগ্রদ্বীপের ঘোষপাড়ারও। ভাঙনের জন্য পাড়াটাই বিধ্বস্ত। এক সময়ে যে সেখানে বসতি ছিল, বোঝা যায় পড়ে থাকা ইটের টুকরোয়। বাসিন্দাদের দাবি, বিঘার পর বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। জমির উপরে নির্ভর করে থাকা মানুষজন ভ্যান-রিকশা চালিয়ে এখন জীবিকা নির্বাহ করছেন। ভাঙন-রোধের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ফল হয়নি।
পূর্বস্থলীর ঝাউডাঙা গ্রামের সঞ্জীবন বিশ্বাসের দাবি, ভাঙনের জন্য কত পরিবার এলাকা ছেড়ে কালনা স্টেশন বা পূর্বস্থলী স্টেশন এলাকায় অস্থায়ী ভাবে বাস করছেন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। উন্নতি সাহার প্রশ্ন, “আমাদের বাড়ি-জমি সবই গেল। শুকনো আশ্বাস ছাড়া আর পেলাম কী?” এই প্রশ্নটাই অগ্রদ্বীপ থেকে জালুইডাঙা, গলসির চরমানা থেকে জামালপুর, ভাঙন-বিধ্বস্ত সব এলাকার বাসিন্দাদের। গলসিতে দামোদরের ভাঙনে জমি-হারা হয়েছেন অমরপুর, জয়কৃষ্ণপুর, গোপডাল-সহ গোটা বাইশটি গ্রামের মানুষজন। সেখানকার বাসিন্দা বিমল ভক্তের কথায়, “ভাঙন আমাদের জীবিকা পর্যন্ত পাল্টে দিচ্ছে। প্রতি বছর ভাঙনের জন্যে বিঘার পর বিঘা জমির সলিল সমাধি ঘটছে।’’ একই বক্তব্য জামালপুর-খণ্ডঘোষ-রায়নার বাসিন্দাদেরও।
ভোটের ভেঁপু বাজতেই ভাঙন-রোধের আশ্বাস নিয়ে ময়দানে হাজির সব পক্ষ। বর্ধমান পূর্বের বিজেপি প্রার্থী পরেশচন্দ্র দাসের বক্তব্য, “আমার এলাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাগীরথী ও দামোদরের ভাঙন। এর সমাধান করতে গেলে মাস্টারপ্ল্যানের প্রয়োজন। সংসদে যেতে পারলে এ নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা সরকারের কাছে তুলে ধরব।’’ সিপিএমের ঈশ্বরচন্দ্র দাসের অভিযোগ, ‘‘ভাঙন রোধের জন্যে বহুজাতিক সংস্থাকে আনা হয়েছিল বাম আমলে। দেশীয় পদ্ধতির মাধ্যমে বাম সরকার ভাঙন রোধে বড় পদক্ষেপ করেছিল। সেই সব উদ্যোগের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটিয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। সে জন্যই ভাঙন বেড়ে চলেছে।’’ তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী সাংসদ সুনীল মণ্ডলের দাবি, ‘‘ভাঙন রোধে আমরা সব সময় চেষ্টা করে চলেছি। দামোদর ও মুণ্ডেশ্বরীর সংযোগস্থলে ব্যারাজ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে।’’
চৈত্রের বিকেলে আকাশে কালো মেঘ। নদীর ঢেউ দেখে ইছাময়ীদেবী বলেন, “এই ঢেউই আমাদের এখানে পিছিয়ে এনেছে। আর কত পিছোব? আমাদের তো আর থাকার জায়গাও নেই। ভাঙন আটকানো গেলে বাঁচতাম।”
ভোটের বাজারে তর্জা চলছে। ইছাময়ীদের ইচ্ছেপূরণ কবে হবে, সে প্রশ্নের উত্তর অজানাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy