Advertisement
০১ মে ২০২৪
বলছেন শক্তিগড়ের গোপালপুরের বাসিন্দারা
Couple Suicide Shaktigarh

অভাব আর সহজে পাওয়া ঋণই কাল

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলা জুড়ে মাকড়শার জালের মতো ঋণের ফাঁদ ছড়িয়ে রয়েছে। ঋণ দানকারী সংস্থাগুলি নানা প্রলোভন দেখিয়ে মহিলাদের হাতে টাকা কার্যত গুঁজে দেয়।

Couple Suicide shaktigarh

ঋণের কাগজ খতিয়ে দেখছেন মৃত দম্পতির বড় ছেলে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শক্তিগড় শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৪
Share: Save:

রাস্তার কল থেকে বালতিতে পানীয় জল ভরছিলেন শক্তিগড়ের রাজেকা বিবি। মোটরবাইক নিয়ে তাঁর পাশে হাজির এক যুবক। বলেন, ‘আমি একটি সংস্থায় কাজ করি। তারা মহিলাদের উন্নয়নের জন্য ঋণ দেয়। আপনি কি ঋণ নেবেন?’ আধার আর ভোটার কার্ডের প্রতিলিপি জমা দিয়েই ঋণ পেয়ে যান রাজেকা। এ বার রাজেকাকে ‘উদাহরণ’ করে ওই সংস্থা একের পর এক মহিলাকে ঋণ দিতে শুরু করে। এই ছবি বড্ডই চেনা পূর্ব বর্ধমানের নানা গ্রামে। আর এই সহজ ঋণেই জড়িয়ে নানা ‘ফাঁস’।

রাজেকার কথায়, ‘‘ঋণ দেওয়ার জন্য বার বার আমাদের কাছে আসছিলেন ওঁরা। অভাবের সংসারে টাকা সব সময় দরকার। কিন্তু একবার ওই ঋণ নিয়ে ফেলে জালে জড়িয়ে পড়েছি।’’ তাঁর দাবি, প্রতি সপ্তাহে ঋণ শোধ করতে হয়। শোধ করতে না পারলে ওই সব সংস্থার কর্মীরা দিনভর বাড়িতে বসে থাকেন। যতদিন না ঋণের কিস্তি পাচ্ছেন, ততদিন বাড়িতে আসতেই থাকেন। এতে ঋণ গ্রহীতাদের উপরে চাপ তৈরি হয়। শক্তিগড়ের গোপালপুর গ্রামের আত্মঘাতী প্রৌঢ় দম্পতি হেমন্ত মালিক ও রেখা মালিকও ঋণ শোধের চাপেই সে পথ বেছে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন পরিজনেরা।

বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ি থেকে তাঁদের মৃতদেহ পুলিশ উদ্ধার করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, মায়ের নামে একাধিক ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন ছোট ছেলে রমেশ মালিক। কিস্তি মেটাতে না পেরে তিনি স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে ‘বেপাত্তা’ হয়ে যান। সব চাপ পড়ে ওই প্রৌঢ় দম্পতির উপরে। দম্পতির বড় ছেলে সনাতন বলেন, ‘‘বুধবার দিনভর কিস্তি শোধের দাবিতে ওই সব ঋণদানকারী সংস্থার লোকেরা বাড়িতে বসেছিলেন। বাবা ও মা সারা দিন কিছু খায়নি। রাতে চা খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁদের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পাই।’’ এলাকার বাসিন্দা মাধবী পাল, সুতপা মণ্ডলদের দাবি, ‘‘ঋণ পেতে গোষ্ঠীর প্রয়োজন নেই, কাগজপত্রের বালাই নেই। ব্যাঙ্কেও ছুটতে হয় না, বাড়িতে বসেই ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে না পারলেই চাপ তৈরি করে।’’

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলা জুড়ে মাকড়শার জালের মতো ঋণের ফাঁদ ছড়িয়ে রয়েছে। ঋণ দানকারী সংস্থাগুলি নানা প্রলোভন দেখিয়ে মহিলাদের হাতে টাকা কার্যত গুঁজে দেয়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির গবেষক ভাস্কর গোস্বামী বলেন, ‘‘করোনার পরে মানুষের হাতে কাজ অপ্রতুল। সহজলভ্য পদ্ধতিতে ওই সব সংস্থার কাছে ঋণ নিচ্ছেন তাঁরা। সেটাই দিন দিন অভিশাপ হয়ে যাচ্ছে।’’ ওই সব সংস্থায় ঋণ শোধ করার জন্য প্রায় ২৪ শতাংশ সুদ দিতে হয়। সেখানে রাজ্য সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। তার পরেও ওই সব সংস্থার রমরমা কেন? ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রয়োজনের সময় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না। নানা জটিলতা তৈরি করা হয়। সেই কারণে সুদ বেশি জেনেও প্রয়োজন মেটাতে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার দ্বারস্থ হন অনেকে। অনেকেরই ধারণা, গ্রামে গ্রামে সমবায়গুলি সক্রিয় থাকলে এই সব সংস্থার উত্থান হত না।

বর্ধমান কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের দাবি, খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, গ্রামের মহিলারা সমবায় থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু শোধ করেননি বলে আর ঋণ পাননি। তখন ওই সব সংস্থায় জড়িয়েছেন। ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান উত্তম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই সব সংস্থার রমরমা বন্ধ করার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক মানুষদের জন্য একাধিক প্রকল্প রয়েছে।’’ তবে ঋণ বা কিস্তি পরিশোধের জন্যে চাপ দেওয়ার কথা কোনও ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার কর্তারা মানতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shaktigarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE