কাজের মাঝে পূজা। নিজস্ব চিত্র
সকাল হোক বা রাত, শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বাইক ছুটিয়ে খাবার পৌঁছে দেন তিনি। কাজ শুরুর সময়ে সমাজের কটূক্তি, বাঁকা চাহনি, নিরাপত্তার ভয় ছিল। এখন অনেক বয়স্কের কাছে তিনিই অন্নপূর্ণা। বর্ধমান শহর লাগোয়া রায়ানের নারায়ণদিঘির পূজা রায় বলেন, ‘‘নেতিবাচক কিছু নিয়ে ভাবি না। ৮০ শতাংশ মানুষের কাছেই ভালবাসা পেয়েছি। তাঁদের জন্যই চার বছর ধরে কাজ করতে পারছি। সংসারটাও সামলে নিয়েছি।’’
পূজার বাবা স্বপনকুমার রায় সাইকেলের দোকানে কাজ করতেন। টুকটাক গ্যাস সারানোর কাজও করতেন। তবে পূজা মাধ্যমিক পাশ করার পরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সংসার যেন আর চলছিল না। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই টিউশন শুরু করেন পূজা। লড়াই শুরু তখন থেকেই। বছর সাতাশের ওই তরুণী জানান, শুধু টিউশনের টাকায় সংসার চলছিল না। বাড়তি রোজগারের আশায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হয়ে প্রচার করতে শুরু করেন তিনি। বাবার চিকিৎসা করান। পাশাপাশি বর্ধমান মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক হন নিজেও। কম্পিউটার, মার্কেটিংয়েরও প্রশিক্ষণ নেন। পূজা বলেন, ‘‘২০১৬ সালে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ শুরু করেছিলাম। তিন বছর পরে এই খাবার সরবরাহকারী সংস্থায় ডেলিভারি গার্লের চাকরি নিই। সেই কাজই করছি এখনও।’’
সেই সময়ে শহরে একমাত্র তিনিই ছিলেন ‘ডেলিভারি গার্ল’। সাইকেল নিয়ে প্রতিদিন প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হত। সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতেন। মাস গেলে রোজগার হত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। সংসার খরচ সামলে সেখান থেকে টাকা জমাতেন তিনি। ওই টাকা থেকেই কেনেন মোটরবাইক। এখন বাইকেই চলে তাঁর সওয়ারি। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে বাবা-মেয়ে মিলে নিজেরে বাড়ি করেছেন তাঁরা। বর্তমানে পূজাকে দেখে আরও অনেকে শুরু করেছেন এই কাজ।
রাত-বিরেতে খাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে অসুবিধার মুখে পড়তে হয়নি? পূজা বলেন, ‘‘এ আর নতুন কী! নানারকম কটূক্তি শুনতে হয়েছে। ফোনেও অনেকে কুকথা বলেছেন। খাবার সরবরাহ করি বলে অনেক পরিচিত আমাকে এড়িয়ে গিয়েছেন। একটা সময় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তখন সাহ জুগিয়েছে আমার বান্ধবী পল্লবী দে।’’ পল্লবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই রাতে খাবার পৌঁছে দিতেন তিনি। পূজার দাবি, ‘‘ও ফোন রাখত না। যাতে কোনও বিপদে পড়লে অন্তত কেউ জানতে পারে। বাবা-মা ছাড়া অনেক সাহস পেয়েছি ওর থেকে।’’ তবে রাতে দরজা খুলে খাবার নিয়ে কোনও বয়স্ক মানুষ যখন মাথায় হাত রাখেন, সব কষ্ট ভুলে যান পূজা। তিনি বলেন, ‘‘খাবার হাতে নিয়ে যখন কেউ বলেন, ‘এই তো অন্নপূর্ণা এসেছে’, সব ক্লান্তি ভুলে যাই। মনে হয়, আমার চেয়ে ভাগ্যবান আর কে আছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy