রঙবেরঙের সুতোয় বাহারি শাড়ি বুনেও ভাল বাজার মেলে না— সাধারণ তাঁতিদের এ অভিযোগ বহুদিনের। এ বার ভিন রাজ্য তো বটেই, তাঁদের দেশ-বিদেশে বাজার খুঁজে পাওয়ার দিশা দেখাতে এগিয়ে এল জয়পুরের এক সংস্থা। পূর্বস্থলীর পাঁচটি ব্লকের স্বয়ম্বর গোষ্ঠীর তাঁত শিল্পীদের দু’মাসের প্রশিক্ষণ শিবিরে তাঁরা শেখাচ্ছেন, কী ভাবে ডাক মারফত নমুনা পাঠানোর ঝক্কি কাটিয়ে অনলাইনে শাড়ির ছবি তুলে পাঠিয়ে সহজেই নজর কাড়া যায় ক্রেতার। সঙ্গে আধুনিক ক্রেতাদের কোন ধরনের নকশা বেশি পছন্দ, সে সবেরও সন্ধান দিচ্ছেন তাঁরা।
পূর্বস্থলী ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার জনসাধারণের একটা বড় অংশ বহু বছর ধরে তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বেশ কিছু মহিলা স্বয়ম্বর গোষ্ঠী রয়েছে। সম্প্রতি এই গোষ্ঠীগুলিকেই সরকারি প্রকল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ করেন বর্ধমানের জেলাশাসক। এরপরেই শ্রীরামপুর, নসরতপুর এবং সমুদ্রগড় পঞ্চায়েত এলাকার পাঁচটি স্বয়ংভর গোষ্ঠীর ৬০ জন মহিলাকে নিয়ে পয়লা এপ্রিল থেকে পঞ্চায়েত সমিতি লাগোয়া খাদিভবনে শুরু হয় দু’মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির। জয়পুরের ‘স্মলটাউন’ নামে ওই সংস্থার বিশেষজ্ঞদের হাজিরায় বৃহস্পতিবার প্রথম দফার ১৫ দিনেক প্রশিক্ষণ শেষ হয়। সংস্থাটির দাবি, খুব শীঘ্র শুরু হবে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ।
নতুন কি রয়েছে এই শিবিরে?
প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা জানান, পূর্বস্থলী এলাকায় মূলত বালুচরি শাড়ি বোনা হয়। হস্তচালিত তাঁতে তৈরি এই শাড়ির ক্রেতা এলাকারই কিছু মহাজন। যাঁরা স্থানীয় এবং রাজ্যের নির্দিষ্ট কিছু বাজারে এই শাড়ি বিক্রি করেন। দীর্ঘ দিন ধরে এই পদ্ধতিতে শাড়ি বিক্রি চলছে। তবে এতে লাভ তেমন হয় না বলেও বহু দিন ধরেই অভিযোগ তাঁতিদের। শিবিরে দেখানো হয়েছে, দেশ বিদেশের ক্রেতাদের শাড়ি কেনার রুচি কেমন। কোন নকশা, কোন ধরনের ক্রেতারা পছন্দ করেন। প্রশিক্ষিতদের এক জন, সমুদ্রগড়ের বাসিন্দা বিনতা মণ্ডল জানান, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন অযথা বেশি রং ব্যবহার করে শাড়ির স্বাদ নষ্ট না করতে। আঁচল এবং পাড়ে নির্দিষ্ট কিছু নকশা ব্যবহার করতে, বিশেষত জ্যামিতিক ডিজাইন। শ্রীরামপুরের বাসিন্দা সীমা মজুমদার, জয়শ্রী মজুমদারদেরও বক্তব্য, ‘‘ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে শাড়িতে প্রাকৃতিক রং বেশি ব্যবহার করতে। এর সঙ্গেই প্রজাপতি, জবাফুল, সবুজ ও ঝরা পাতার মতো বিষয়ের রঙ কীভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে তা দেখানো হয়েছে।
তবে শুধু শাড়ি বুনলেই হবে না, সে শাড়ি বিক্রির জন্য কিভাবে অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে তাও নিখুঁত ভাবে শেখানো হয়েছে শিবিরে। গ্রামের মেয়েদের দেখানো হয়েছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিভাবে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে হয়। পণ্য বিক্রির জন্য ফেসবুক এবং হোয়াটস অ্যাপ অ্যাকাউন্ট খোলার কথাও বলা হয়েছে। শেখানো হয়েছে কিভাবে, কোন আলোয় ছবি তুলতে হবে। এ ছাড়া শুধু শাড়ি নয়, শাড়ির আবহে ঘরোয়া পরিবেশ কীভাবে রাখতে হবে ছবিতে, তাও সেখানো হয়। শিবির চলাকালীনই অনেকে মোবাইলে বোনা শাড়ির ছবি তুলে নিয়ে আসেন। ওই সংস্থার দাবি, তাঁরা শাড়িগুলি নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেছেন, যা দেখে সিঙ্গাপুর-সহ পৃথিবীর নানা দেশের ক্রেতারা শাড়ি কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। শিবিরে যোগ দেওয়া নসরতপুরের বিজয়া বিশ্বাস বলেন, ‘‘শিবিরে এসে আমরা আত্মবিশ্বাসী। মনে হচ্ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছিলাম, সংস্থাটি হাত ধরে টেনে তুলেছে। দেখে নেবেন ঠিক হাঁটতে পারব।’’
প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের দিশা দেখিয়ে খুশি সংস্থার লোকজনও। সংস্থাটির ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার নেহা বলেন, ‘‘হ্যান্ডলুমের শাড়ির প্রতি বিশ্বের বহু ক্রেতার দুর্বলতা রয়েছে। অনেক শাড়ি বিভিন্ন দেশে ৭০-৮০ হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। গ্রামের এই মেয়েদের শেখার আগ্রহ রয়েছে। ওরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’’ তিনি জানান, তাঁতিদের কাপড়ের নমুনা ক্রেতাদের পাঠাতে হয় কুরিয়ারে। দিল্লি,চেন্নাইয়ের মতো জায়গাতেও শাড়ির নমুনা পৌঁছতে ৪-৫ দিন লেগে যায়। অনলাইনে সে সমস্যা নেই। বরং নমুনা দেখে ক্রেতা পছন্দমতো কিছু এদিক-ওদিকও করতে পারবেন। আর এক ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার বিশ্বজিৎ জানান, হ্যান্ডলুমের তৈরি পণ্যের প্রতি আকর্ষণ ক্রমশ বাড়ছে। টানা প্রশিক্ষণ দিয়ে চেষ্টা করা হবে যত সম্ভব তাঁত শিল্পীকে বাজারের খোঁজ দেওয়া।
এ দিন ৬০ জন মহিলার হাতে মানপত্রও তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ছিলেন রাজ্যের ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ।