বরাবর লাল স্বর্ণ প্রজাতির ধান চাষ করাই অভ্যাস এ জেলার বেশির ভাগ চাষির। পোকার আক্রমণ, কম ফলন— কোনও কিছুই টলাতে পারে না তাঁদের। এমনকী, কৃষি বিশেষজ্ঞরা বারবার খাদ্যাভ্যাসের বদলের দিকে তাকিয়ে সরু ও সুগন্ধী চালের চাষ বাড়ানোর কথা বললেও চিরাচরিত চাষ থেকে নজর ঘোরান না তাঁরা। কিন্তু বছরের পর বছর একই চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমিও। বিশেষজ্ঞরাই জানাচ্ছেন, একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির ধান চাষে এক দিকে যেমন ফলন কমছে, তেমনি প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে বাড়ছে চাষের খরচ।
কৃষি দফতরের হিসেবে এ জেলায় সাড়ে তিন লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমিতে আমন চাষ হয়। বোরো চাষও হয় দেড় লক্ষেরও বেশি হেক্টর জমিতে। এই বিপুল পরিমাণ ধান উৎপাদন করতে জেলার ৮০ শতাংশের বেশি চাষিই নিজেদের জমিতে লাল স্বর্ণ প্রজাতির ধান চাষ করেন। কৃষি কর্তারা জানিয়েছেন, ধানের এই প্রজাতির বয়স দু’দশকেরও বেশি। মূলত কম পরিশ্রম এবং বেশি ফলনের টানেই মোটা ধানের এই প্রজাতির চাষের এলাকা ক্রমশ বাড়ে। তবে একটানা এই প্রজাতির চাষে ফলন ক্রমশ নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে। দেখা দিচ্ছে রোগ পোকা। চাষিরাই জানান, মাজরা, ভেপু, পামরি, বাদামি শোষক, গন্ধীর মতো পোকার হামলা দেখা দিচ্ছে চাষের বিভিন্ন সময়। দেখা দিচ্ছে ঝলসা, খোলাপচার মতো রোগও। ফলে এক দিকে কীটনাশকের খরচ বাড়ছে, সঙ্গ কমছে ফলন। মেমারির চাষি গোবিন্দ সরকার বলেন, ‘‘বছর দশেক আগেও বিঘা প্রতি জমিতে প্রায় ২০ মণ লালস্বর্ণ ধান ফলত। এখন তা দাঁড়িয়েছে ১৬ থেকে ৮ মণে।’’ আর এক চাষি কালীপদ বাগ বলেন, ‘‘লালস্বর্ণ ধানে সব থেকে বেশি মাজরা পোকার হামলা দেখা দেয়।’’ চাষিদের দাবি, গত চার পাঁচ বছরে এই ধানের তেমন দামও মিলছে না। বহু সময় দীর্ঘ দিন ধরে গোলায় ধান মজুত রেখেও মিলছে না লাভজনক দর।
কেন এমন সমস্যা?
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৩০ থেকে ১৩৫ দিনের এই ধান চাষে সাধারণত ভাল ফলন মেলে। তাই আগ্রহও বেশি। তবে সাধারণত দশ বছরের বেশি কোনও প্রজাতির ধানই টানা চাষ না করা উচিত বলে তাঁদের দাবি। সে ক্ষেত্রে ওই গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। নানা ধরনের পোকার হামলাও বাড়ে। এই কারণেই বছর দুয়েক আগে থেকে প্রদর্শনী বা সরকারি অনুষ্ঠান থেকে লাল স্বর্ণ ধানের বীজ বিলিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলার এক সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, ‘‘সারা বছরই চাষিদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বৈঠক, আলোচনা সভা হয়। সেখানে বারবার লাল স্বর্ণ প্রজাতির ধান চাষকে এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বদলে কোন ধান চাষে লাভ হবে, তা বলে দেওয়া হচ্ছে।’’ জেলার এক কৃষি কর্তার কথায়, ‘‘চাষিদের মধ্যে চিরাচরিত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা কম থাকে। সে কারণেই এই বদলটাতে সময় লাগছে।’’
লাল স্বর্ণ ধান থেকে এক সময় প্রচুর চিড়ে এবং মুড়ি তৈরি হতো। কিন্তু চাষিরাই জানাচ্ছেন, আগের থেকে চিড়ে, মুড়ির চাহিদা কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি জেলার মানুষের একটা বড় অংশ সরু চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, হোটেল, রেস্তোরাঁতেও সরু, সুগন্ধি চালের ব্যবহারই বেশি। পূর্বস্থলী, ভাতার, মন্তেশ্বর, খণ্ডঘোষ, জামালপুর মতো কয়েকটি ব্লকে গোবিন্দভোগ এবং বাদশাভোগের মতো সুগন্ধী চালের চাষি বাড়লেও চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট কম। ফলে ভিন রাজ্যের চালের উপরেই নির্ভর করতে হয় অনেকাংশে। আর জেলায় উৎপাদিত লাল স্বর্ণের মতো মোটা ধান চাষিদের কাছ থেকে সহায়ক মূল্যে কিনে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চাল তৈরি করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, লাল স্বর্ণের বিকল্প হিসেবে স্বর্ণমাসুরি, সাম্বামাসুরি, ছাপান্ন-ছাপান্ন, প্রতিজ্ঞার মতো মোটা ধানের চাষ করা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই এই প্রজাতিগুলি জেলার মাটিতে পরীক্ষিত। পাশাপাশি সরু ধান হিসাবে শতাব্দী, ক্ষিতিশ, আর-আর-৩৬ জাতীয় ধানের চাষ করলে মিলবে ভাল ফলন। পার্থবাবু বলেন, ‘‘সরু ধান চাষের দু’ধরনের সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, চাহিদা থাকায় ভাল দর মেলে। দ্বিতীয়ত, মোটা ধানের থেকে অন্তত কুড়ি দিন আগে ফলন ওঠে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে রবি চাষ করতে পারেন চাষিরা।’’
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘বর্ধমানে দীর্ঘদিন ধরে লাল স্বর্ণ চাষ হচ্ছে। চাষিরা এই চাষ আরও করলে মারাত্নক খোলাপচা রোগ হতে পারে। অনেক নতুন প্রজাতির ধান এসেছে। এ বার অন্য দিকে দেখা উচিত।’’