বাবার শেষকৃত্যের জন্য সবাই কবরস্থানে হাজির। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও তিনি ছিলেন। তার পরেই উধাও। খোঁজ নিতেই জানা গেল, ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনীর কাজে রাস্তায় ঘুরে গণনাপত্র জমা নিচ্ছেন তিনি। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের মাধপুরের ১৩৫ নম্বর বুথের বিএলও মেহমুদ-উল-আলম এমনই। ওই বুথে ৮৯১ জন ভোটারের মধ্যে বিএলও অ্যাপের গোলমালের জেরে তিন জনের গণনাপত্র ডিজিটাইজ় করতে পারেননি তিনি। বাকি সমস্ত ফর্ম আপলোড করা হয়ে গিয়েছে। সোমবার এসআইআর সংক্রান্ত সব নথি ব্লকে জমাও দিয়েছেন।
জামালপুরের ৬ নম্বর বুথের বিএলও মঞ্জু বাগ থাকেন মেমারির পাল্লায়। পেশায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মঞ্জুকে জামালপুরের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের চক কৃষ্ণপুর ও উত্তম চাঁদপুরের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র সামলাতে হয়। প্রতিদিন ভোর ৬টায় নৌকা করে দামোদর পার করে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পৌঁছে যান তিনি। কচিকাঁচাদের শামলে এসআইআরের কাজ করেন। বাড়ি ফিরতে রাত ৮টা। তারপরে আবার গণনাপত্র ডিজিটাইজ় করার কাজ। মঙ্গলবার তাঁকে সম্মান জানান বিডিও পার্থসারথী দে।
কেতুগ্রামের পাণ্ডুগ্রাম পঞ্চায়েতের পায়রাকান্দি গ্রামের ১৪৯ নম্বর বুথের বিএলও কবিতা সাহা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। তাঁর বুথে ৫৬৬ জন ভোটার। অ্যাপের গোলমালের জন্য চার জনের তথ্য ‘নট রেকর্ড ফাউন্ড’ দেখানোয় ডিজিটাইজ় করা যায়নি। কবিতার কথায়, “৫৬৬ জন ভোটারের মধ্যে বড়জোর শ’খানেক ভোটার নিজের হাতে ফর্ম পূরণ করে আমাকে জমা দিয়েছেন। বাকিদের ফর্ম পূরণ হয় আমি নিজে করে দিয়েছি কিংবা আমার নির্দেশ মতো ভোটারেরা করেছেন। ফলে, এক-একটা ফর্ম পূরণ করতে অনেক বেশি সময় দিতে হয়েছে।”
রাজ্যে ৮০ হাজারের বেশি বুথের মধ্যে ‘সেরা ১০০’ বিএলও-র তালিকা করেছে কমিশন। তাঁরা ১০০ শতাংশ কাজ শেষ করে ফেলেছেন বলে কমিশনের দাবি। সেই তালিকায় উপরের তিন জন ছাড়াও পূর্ব বর্ধমানের আরও দু’জন রয়েছেন। তাঁরা হলেন কেতুগ্রামের ধান্দলসার অপূর্ব দত্ত ও আউশগ্রামের ২১৮ নম্বর বুথের গণেশচন্দ্র পাল। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “পাঁচ জনকেই সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তাঁদের সাফল্যের গল্প নিয়ে ভিডিয়ো তৈরি করবে কমিশন।” সোমবার কেতুগ্রামের পায়রাকান্দি গ্রামে গিয়ে কবিতার ভিডিয়ো করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
মেহেমুদ জানান, ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নিউটাউনের একটি সরকারি হাসপাতালে তাঁর বাবা ভর্তি ছিলেন। এক দিকে এসআইআরের কাজ, সঙ্গে বাবার চিকিৎসা করিয়েছেন। । শনিবার হাসপাতাল থেকে আসার পরে তাঁর বাবা মারা যান। এসআইআর চলাকালীন প্রায় ১৪ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকতেন জামালপুরের মঞ্জু। ৫৬ বছরের মঞ্জু চক কৃষ্ণপুরে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো-পড়ানো সেরে চলে যেতেন পাশের উত্তম চাঁদপুরের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। সেখানে কাজ শেষে নির্দিষ্ট পোর্টালে তথ্য ‘আপলোড’ করে এসআইআরের কাজে বেরিয়ে পড়তেন। তিনি বলেন, “এই ক’টা দিন সংসার সামলেছে স্বামী আর ছেলে। চার দিন জ্বরে পড়ে না থাকলে আরও কয়েকটা দিন আগে গণনাপত্র ডিজিটাইজ় করে জমা দেওয়া হয়ে যেত।” কেতুগ্রামের কবিতা বলেন, “আমার বুথে বেশির ভাগ ভোটার কৃষিজীবি। রাতেও তাঁদের বাড়ি গিয়ে কাছে বসিয়ে ফর্ম পূরণ করতে হয়েছে। তারপরে রাত জেগে ফর্ম ডিজিটাইজ় করেছি। মনে হচ্ছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি।’’
এসআইআরের কাজ নিয়ে দিকে দিকে বিএলওদের বিক্ষোভ হচ্ছে। অতিরিক্ত চাপে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কারও মৃত্যুও হয়েছে। সেখানে এমন উলটপুরাণ? মেহমুদ বলেন, “প্রশিক্ষণে মনোযোগী ছাত্র ছিলাম। তারপরে সময়ানুবর্তিতা আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করি। সে কারণে চাপটা গায়ে লাগেনি।” মঞ্জুর কথায়, “ইচ্ছা থাকলেই চাপ কাটানো যায়। না হলে নদী পেরিয়ে, কেন্দ্র সামলে ১৪ ঘণ্টা ধরে এসআইআরের কাজ সময়ে করতে পারতাম না।” কবিতাও বলেন, “চাপ থাকবে, কষ্ট থাকবে। কিন্তু দায়িত্বও তো নিতে হবে।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)