Advertisement
E-Paper

বাল্যবিবাহ রোখার পথ সুগম নয়

আমরাও মেয়েদের আঠারো বছর আর ছেলেদের একুশ বছরের নির্ধারিত বয়সসীমা সম্পর্কে সব জেনেও এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাই।

পুষ্পেন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
নিজেরাই: এক স্কুলছুটের বাড়িতে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা। ফাইল চিত্র

নিজেরাই: এক স্কুলছুটের বাড়িতে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা। ফাইল চিত্র

আইন প্রণীত হয়। কিন্তু অনেক শ্লথ গতিতে মানুষের মনে পরিবর্তন আসে। দেড় শতাব্দী আগে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হলেও আজও তার সামাজিক মান্যতা সর্বস্তরে তেমন করে মেলেনি। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

একটি কৌতূহল জাগানো ঘটনা এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে। উনিশ শতকের ব্যক্তিত্ব কেশবচন্দ্র সেন, যাঁর প্রয়াসে ১৮৭২ সালে অসবর্ণ বিবাহ ও বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বাল্যবিবাহ ও বহুগামিতার বিরুদ্ধে ‘নেটিভ (ব্রাহ্ম) ম্যারেজ অ্যাক্ট’ বলবৎ হয়, সেই তিনিই ১৮৭৮ সালে তাঁর তেরো বর্ষীয়া কন্যা সুনীতিদেবীর বিবাহ স্থির করেন কোচবিহারের মহারাজের সঙ্গে। আর পাঁচ জনের মতো এই আলোকিত মানুষটিও বলে উঠলেন, ‘এ বিবাহ নিয়তি নির্ধারিত’। কী স্ববিরোধ!

আমরাও মেয়েদের আঠারো বছর আর ছেলেদের একুশ বছরের নির্ধারিত বয়সসীমা সম্পর্কে সব জেনেও এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাই। সত্যি কথা বলতে, ২০১০ সালে এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে বিষয়টি আমাকেও ভাবায়নি তেমন করে। কিন্তু কিছু দিন গ্রামাঞ্চলে কাজ করার পরে এই আপাত লঘু বিষয়ের গুরুত্ব মালুম হয়। আসলে তেমন চোখ তৈরি করতে পারলে এক জন ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের (বিডিও) কাছে সমাজ তার সমস্ত ক্লেদ, গ্লানি, রূপটান নিয়ে হাজির হয়।

হাসপাতালে হাজির রুগ্ণ মায়েদের বেশির ভাগ বাল্য বিবাহিতা, অপুষ্ট মায়েদের বেশির ভাগই বাল্য বিবাহিতা মায়ের সন্তানও। অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্রেও চিত্রে বদল নেই কোনও। ছাত্রীদের স্কুলছুটের মুখ্য কারণ বাল্যবিবাহ। যে মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিতা হয়ে বিডিও-র অফিসে বিচার চাইতে আসে, সেও বাল্য বিবাহিতা। সে লেখাপড়া করেনি, তার স্বাভিমান তৈরি হয়নি। পরিসংখ্যান জানান দিচ্ছে, গ্রামবাংলার প্রতি একশোটি মেয়ের মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ জনের বিয়ে হয়ে যায় আঠারোতম জন্মদিন পেরনোর আগেই। দেশের গড় থেকে পশ্চিমবঙ্গে এ প্রবণতা বেশি। ভাবা যায়! এই সেই বাংলা, যা ভারতবর্ষে প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার স্পর্শ পেয়েছিল।

এ নিয়ে যখন বাঁকুড়ার ইন্দাসে একটুআধটু কাজ শুরু করেছি, তখন এসে পৌঁছল ‘কন্যাশ্রী’। এই প্রকল্পকে সামনে রেখে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কর্মসূচিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হল। স্কুলেস্কুলে কর্মশালা শুরু করা হল। দেখলাম, ছাত্রীরা আইনের কথা জানে। কিন্তু কেন এই বিবাহের বয়স নির্দিষ্ট করে দেওয়া, তা জানে না। না জানলে প্রতিরোধ হবে কোন শক্তিতে? উল্টো দিকে মুশকিল হল এই যে, সর্বত্র সেই কেশবচন্দ্র-সুলভ স্ববিরোধ বিদ্যমান। স্কুলের পরিচালন কমিটি এবং শিক্ষকদের একাংশও বাল্যবিবাহকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই মনে করেন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দুর্নাম ও অসম্মান অর্জন করার উচ্চাশাও তাঁদের নেই।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গিয়ে দেখেছি, নানা কুযুক্তির অবতারণা। কেউ বলেছেন, ‘‘বিয়ে তো নিয়তি-নির্ধারিত। সেখানে কারই বা কী বলার থাকতে পারে?’’ আবার কারও বক্তব্য, ‘‘ভাল ছেলে পেয়ে গেলাম। দাবিদাওয়া নেই। আমরা গরিব মানুষ। এ পাত্র হাতছাড়া হলে আর কি পাব?’’ অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, শাশুড়ির ইচ্ছে, কমবয়সী মেয়েকে বধূ করে ঘরে আনা। তাতে সে তাঁর কথা শুনবে এবং নিজের মতো গড়েপিটেও নেওয়া যাবে। আবার এক জন প্রাথমিক শিক্ষকের কথায়, ‘‘দেখুন মশাই, মেয়ে আমার বড় হয়েছে। ও কলেজে যাবে, ছেলেরা তাকাবে, প্রেম-ভালবাসা করবে— এ আমার ঘোর অপছন্দ।’’

এই মতামতেরই প্রায় কাছাকাছি আরেকটি প্রতিরোধ প্রায় শুনতে পাই—‘‘আমরা না হয় বিয়ে দিলাম না! কিন্তু ছেলেমেয়েরা যদি নিজেরা বিয়ে করে নেয়, তখন সমাজে মুখ দেখাব কী করে?’’ এই প্রশ্নগুলি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দারিদ্র নয়, পুরুষতান্ত্রিকতা ও বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়েদের নিয়ে এক গভীর সামাজিক অনিশ্চয়তাই বাল্যবিবাহের মতো রোগকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয় মেয়েদের উপার্জনক্ষম মানবসম্পদ হিসেবে ভাবতে না পারার সামাজিক ব্যর্থতা।

দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচার, প্রশাসনের সক্রিয় অবস্থান এবং স্কুলের একটি বড় অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় একটা পরিবর্তন কিন্তু এসেছে। কর্মশালায় ছাত্রীদের যখন জি়জ্ঞেস করা হয়েছে, ‘‘বলো তো, শ্বশুরবাড়িতে কার মতামত বেশি গুরুত্ব পাবে— এক জন ক্লাস এইট পাস মেয়ের না এক জন গ্র্যাজুয়েট মেয়ের?’’ তারা সোচ্চারে উত্তর দিয়েছে, ‘গ্র্যাজুয়েট’। যখন জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘‘সাধারণ ভাবে সন্তানকে জীবনের ঠিক দিশা কে দেখাতে পারবে—এক জন সুশিক্ষিতা মা না এক জন স্বল্পশিক্ষিতা মা?’’ ভোট গিয়েছে সুশিক্ষিতার পক্ষে।

বাল্যবিবাহের কুফলগুলিকে অনেকেই কিন্তু অনেকাংশে চিনতে শিখেছে। তারা জানতে পেরেছে যে—বাল্যবিবাহ নারী শরীরের পরিপূর্ণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে অন্তরায়। বাল্যবিবাহ সুস্থ সন্তানের জন্মের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। বাল্যবিবাহ শ্বশুরবাড়িতে নারীর সম্ভ্রম-সম্মান-গুরুত্ব কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনেরও অন্তরায়।

জেলাশাসকদের নেতৃত্বে ‘কন্যাশ্রী’ এবং সহযোগী জেলা স্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের সফল রূপায়ণে এবং সচেতনতা প্রসারে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ভাল কাজ হচ্ছে। স্কুলে-স্কুলে গড়ে ওঠা ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দৃশ্য-শ্রাব্য বিভিন্ন মাধ্যম ও গণমাধ্যমকে সফল ভাবে ব্যবহার করা, স্কুলে-স্কুলে ‘সেমিনার’, কর্মশালা এই কাজকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলা জুড়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক নাবালিকার বিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। শুধু পূর্বস্থলী ১ ব্লকেই সংখ্যাটি চল্লিশের কাছাকাছি। পূর্বস্থলী ১ ব্লকে চেষ্টা হয়েছে বিয়ের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সকলকে—পুরোহিত, ইমাম, নাপিত, ডেকরেটর, কেটারারদের এ বিষয়ে দায়বদ্ধ করে তুলতে। চেষ্টা করা হয়েছে ‘পুষ্পিতা প্রকল্পে’ (সবুজশ্রী প্লাস) প্রতিটি কন্যার জন্মকে উদ্‌যাপন করে তাকে আদরের সঙ্গে বরণ করে নেওয়ার।

তবে এ কথাও সত্যি যে, বিগত কয়েক বছরে বাল্যবিবাহ-বিরোধী প্রচারের অভিঘাত একটা বড় পরিবর্তন আনলেও, পথ এখনও দুর্গম এবং গন্তব্য দূরবর্তী। নতুন নতুন প্রবণতা তৈরি হচ্ছে প্রশাসনকে ফাঁকি দেওয়ার। যেখানে বাল্যবিবাহ স্থগিত করা হচ্ছে, সেখানে কোনও স্থানীয় প্রভাবশালীর নেতৃত্বে পাত্রপাত্রীকে অন্যত্র পাচার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই চেষ্টা চলছে, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে এই বিষয়ে সংবেদী করে তুলতে।

লেখক পূর্বস্থলী ১-এর বিডিও

Child marriage Prevention
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy