Advertisement
E-Paper

ঝুলন্ত বাস থেকে যাত্রীদের বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন হেল্পার

সেতুর রেলিং ভেঙে ঝুলছে বাস। শোনা যাচ্ছে যাত্রীদের চিৎকার। কিন্তু সাহায্যে এগোবেন কে? বাস যে দুলছে। চালক-কন্ডাক্টর আগেই পগার পার। জড়ো হওয়া লোকজন চেঁচাচ্ছেন। কিন্তু এগোতে ভয় পাচ্ছেন। সাহায্যের হাত বাড়ালেন বাসের প্রৌঢ় হেল্পারই। একে একে সন্তর্পণে নামিয়ে দিলেন ১৫ জন যাত্রীকে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। পা-দানিতে পা রাখামাত্র তাঁকে নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো ফুট নীচে শুকনো নদীখাতে আছড়ে পড়ল বাস।

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:২৪
নদীখাতে বাস। আসানসোল জেলা হাসপাতালে তখনও চিকিৎসাধীন হেল্পার অশোক দে। ছবি: শৈলেন সরকার।

নদীখাতে বাস। আসানসোল জেলা হাসপাতালে তখনও চিকিৎসাধীন হেল্পার অশোক দে। ছবি: শৈলেন সরকার।

সেতুর রেলিং ভেঙে ঝুলছে বাস।

শোনা যাচ্ছে যাত্রীদের চিৎকার। কিন্তু সাহায্যে এগোবেন কে? বাস যে দুলছে।

চালক-কন্ডাক্টর আগেই পগার পার। জড়ো হওয়া লোকজন চেঁচাচ্ছেন। কিন্তু এগোতে ভয় পাচ্ছেন।

সাহায্যের হাত বাড়ালেন বাসের প্রৌঢ় হেল্পারই। একে একে সন্তর্পণে নামিয়ে দিলেন ১৫ জন যাত্রীকে। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না। পা-দানিতে পা রাখামাত্র তাঁকে নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো ফুট নীচে শুকনো নদীখাতে আছড়ে পড়ল বাস।

শুক্রবার সকালে এমনই হাড়হিম করা দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন আসানসোলের কালীপাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা। দিনের শেষে কেউই মানতে পারছেন না এই মর্মান্তিক মৃত্যু।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, যে দুর্ঘটনায় এ দিন অশোক দে (৫৮) নামে ওই হেল্পার প্রাণ হারালেন, তার পিছনে রয়েছে আর একটি মিনিবাসের সঙ্গে রেষারেষি। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটি আসানসোল থেকে রানিগঞ্জ যাচ্ছিল। কালীপাহাড়ির নুনিয়া নদীর ওই সেতুতে ওঠার খানিকটা আগে থেকেই ওই মিনিবাসটির সামনে একই রুটের আর একটি মিনিবাস চলে আসে। শুরু হয় রেষারেষি। সেতুর মাঝখানে পৌঁছে অশোকবাবুদের মিনিবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। ডান দিকের কংক্রিটের রেলিং ভেঙে বাসের সামনের দু’টি চাকা ঝুলতে থাকে। তার আগেই অবশ্য চালক-কন্ডাক্টর পালায়। বাসে তখন ১৫ জন যাত্রী ছিলেন। সকলেই আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলেন।

অশোকবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন চালকের আসনের ঠিক পিছনে। বিপদ দেখেও অশোকবাবু জায়গা ছেড়ে নড়েননি। টলমল বাসের ভিতর থেকে যাত্রীদের কাউকে হাত ধরে, কাউকে দরজার কাছে এনে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছেন। বাকিদের উদ্ধার শেষে তিনি নিজেকেও বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাসটি আর আটকে থাকেনি। তিনি পা-দানিতে পা দিতেই সেতুর রেলিংয়ের বাকি অংশও ভেঙে যায়। নুনিয়া নদীর শুকনো খাতে গিয়ে আছড়ে পড়ে মিনিবাসটি। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে আসানসোল জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্রাণ হারান অশোকবাবু।

ওই হাসপাতালে আহত যাত্রীদেরও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসাধীন তেমনই এক যাত্রী মুর্গাশোলের বাসিন্দা গঙ্গা গোস্বামী তখনও বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর কথায়, “সেতুর কিছুটা আগে থেকে হঠাৎ তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করে। এই অবস্থা হবে বুঝিনি। ওই খালাসিই আমাদের ধাক্কা মেরে নীচে নামিয়ে দেন। উনি না থাকলে...।” আর এক যাত্রী বলেন, “অশোকবাবুর জন্যই জীবন ফিরে পেলাম। তাঁকে এ জীবনে ভুলতে পারব না।”

অশোকবাবুর বাড়ি রানিগঞ্জের বল্লভপুর গ্রামে। অশোকবাবুর স্ত্রী গীতাদেবী বারবার জ্ঞান হারাতে থাকেন। মেজিয়া শ্মশানঘাটে দাঁড়িয়ে অশোকবাবুর দাদা সুকুমার দে বলেন, “পরিশ্রম করে ভাই সংসার সামলেছিল। যখন দায়িত্ব নিত, শেষ করে ছাড়ত। আজও যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে জীবন দিল।” পরিশ্রমী মানুষটাকে শেষবার দেখতে শ্মশানে গিয়েছিলেন এলাকার অনেকেই। ছিলেন অশোকবাবুর ছেলে রবিও। তিনি বলেন, “বাবা সব সময় কাজে ন্যায়নিষ্ঠ থাকার শিক্ষা দিতেন। শেষ দিনেও তাই শিখিয়ে গেলেন।”

কালীপাহাড়ি এলাকায় এমন দুর্ঘটনা এই প্রথম হলেও বাসের রেষারেষিতে প্রাণহানি নতুন নয়। এ জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ প্রচুর। তাঁদের অভিযোগ, প্রশাসনের তরফে নজরদারি বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি।

এ দিন যে চালক যাত্রীদের বিপদে ফেলে বাস ছেড়ে পালাল তার নাম জানাতে চাননি বাস মালিকেরা। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ওই চালকের খোঁজ করা হচ্ছে, পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ দিনের ঘটনা জানার পরে আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস অবশ্য বলেন, “এ বার কঠোর ব্যবস্থা নেবই।” কিন্তু তার আগে আর কত প্রাণহানি হবে, সেই প্রশ্নই তুলে দিয়ে গেলেন অশোকবাবু।

bus accident nunia river asansol
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy