বনমালীর দেহে মালা দিচ্ছেন মন্ত্রী।
ভোট পর্ব মিটেছে, ফল এখনও বাকি। তার মধ্যেই প্রকাশ্যে এল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।
মঙ্গলবার জেলার আটটি বুথে পুনর্নির্বাচনের পরে রাতে আইশগ্রামের ভূঁয়েরা গ্রামে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। বোমাবাজি হয়। বুধবার সকালে বনমালি শেখ ওরফে জিয়াউদ্দিন (২৫) নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ দেহও উদ্ধার হয়। পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় ধরপাকড় চালিয়ে তিন জনকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে বনমালীর বাবা ও ভাই রয়েছে। তবে পুলিশের দাবি, বনমালীর দেহ মেলার আগে ওদের ধরা হয়েছে। তার কোনও আত্মীয় ধৃতদের মধ্যে আছে কি না জানা নেই।
ওই গ্রামে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী সক্রিয়। একটি সুকুমার সাহার, অন্যটি লুৎফর রহমানের। জেলা পুলিশের দাবি, মঙ্গলবার রাতের সংঘর্ষে ওই দুই গোষ্ঠীই জড়িত। নিহত বনমালী লুৎফরের অনুগামী। তবে তৃণমূলের বর্ধমান গ্রামীণের সভাপতি স্বপন দেবনাথ বলেন, “সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই বনমালীকে খুন করেছে।” বুধবার বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মর্গে জেলা তৃণমূল নেতা উত্তম সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে মরদেহে মালাও দিয়েছেন তিনি।
পুলিশ জানিয়েছে, আউশগ্রাম ২ ব্লকের অমরপুর পঞ্চায়েতে গত পঞ্চায়েত ভোটের পরে সিপিএম ৬, কংগ্রেস ৪ ও তৃণমূল ৫টি আসন পায়। পরে সিপিএম ও কংগ্রেস জোট করে বোর্ড গড়ে। প্রধান হন সিপিএমের, আর উপপ্রধান কংগ্রেসের। কিন্তু ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আউশগ্রাম বিধানসভার কংগ্রেস প্রার্থী সুকুমার সাহার বিরুদ্ধে তৃণমূলের তরফে বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয়। গত ১২ জানুয়ারি সুকুমারবাবু তৃণমূলে যোগও দেন। তৃণমূলের একাংশের খবর, সুকুমারবাবু দলে যোগ দেওয়ার পরেই বারবার ওই এলাকায় তৃণমূলের পুরনো নেতা লুৎফর রহমানের সঙ্গে এলাকা দখল নিয়ে তাঁর গোলমাল বাধে। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রায় দিনই ভূঁয়েরা ও লাগোয়া এলাকায় বোমাবাজিও চলত।
জেলা তৃণমূল নেতাদের অবশ্য দাবি, বুধবার রাতে ভূঁয়েরা গ্রামে ঢুকে প্রথমে হামলা চালায় লুৎফরের লোকেরা। বোমার আঘাতে সুকুমার সাহা গোষ্ঠীর তিন জন আহত হন। তাঁদের বর্ধমান মেডিক্যাল হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপরেই সুকুমারের লোকেরা এলাকায় ঢুকে একটি বাড়িতে ভাঙচুর চালায়।” লুৎফর রহমানের অভিযোগ, “রাতে ওরা আমার সমর্থক বনমালীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে সুকুমারের লোকেরা বনমালীকে গুলি করে খুন করে দেহ একটি নালায় ফেলে পালিয়ে যায়। সকালে পুলিশ গিয়ে দেহটি উদ্ধার করেছে। অথচ এই সুকুমার গত ১২ জানুয়ারি আমার হাত ধরেই তৃণমূলে ঢুকেছিল। রাতে ওর লোকেরা গ্রামে দু-তিনটি বাড়িতে ভাঙচুরও করে।” সুকুমারবাবুর সঙ্গে অবশ্য বারবার চেষ্টা করে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি দিনভর নিজের মোবাইল ফোনটি বন্ধ রেখেছিলেন।
আউশগ্রাম ২ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি সুভাষ মণ্ডল জানান, সুকুমার ও লুৎফরের গোলমাল ঠেকাতে তিনি পুলিশকে দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। বুধবার তিনি বলেন, “ওদের জন্য এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে । প্রতি রাতেই ভূঁয়েরা-সহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে চলছে বোমাবাজি।” বনমালিকে কে বা কারা মেরেছে, এই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তিনি বলেন, “এ ঘটনায় সিপিএমের গুন্ডারাই দায়ি।” তবে হাসপাতালে শুয়ে ওই সংঘর্ষে আহত তৃণমূল কর্মী শেখ আমির চাঁদ ও শেখ মালেক স্পষ্ট বলেন, “আমাদের উপরে হামলা করেছিল লুৎফরের লোকেরা। আমরা সুকুমারবাবুর অনুগামী। চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। আচমকা ২০-২৫ জন আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরাও তৃণমূল করে। পরে আমরা প্রতিরোধ করি। আগেও কয়েকবার ওরা আমাদের উপরে হামলা চালিয়েছে।”
বোমায় আহত দু’জন।
গোষ্ঠী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দলের কর্মীর মৃত্যু খবর শুনে মর্গে ছুটে আসেন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। নিহতের পরিবারের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দেন। মন্ত্রীর দাবি, “ওই গ্রামে সিপিএমের জোরালো সংগঠন রয়েছে। সিপিএমই বনমালীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে কানে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা পুলিশকে বলেছি ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতার করতে। নিহতের বাবা ও ভাইকে পুলিশ কেন গ্রেফতার করেছে, তার খোঁজও নিচ্ছি।”
তবে সিপিএমের গুসকরা জোনাল কমিটির সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, “অমরপুর পঞ্চায়েতে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও জোট হয়নি। প্রধান পদটি আদিবাসী মহিলার জন্য সংরক্ষিত। কংগ্রেস বা তৃণমূলের আদিবাসী মহিলা নির্বাচিত না হওয়ায় আমাদের এক পঞ্চায়েত সদস্যাকে প্রধান করেছে ওরা। ভূঁয়েরা গ্রামে আমাদের পতাকা তোলারই লোক নেই। কী করে বনমালীকে খুন করলাম? আসলে নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঢাকতেই তৃণমূল উল্টোপাল্টা কথা বলছে।”
জেলা পুলিশ সুুপার মিরাজ খালিদ বলেছেন, “গত রাতে সংঘর্ষের ঘটনায় ধরপাকড় চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে ওই খুনের ঘটনায় মোট ১৭ জনের নামে এফআইআর দায়ের হয়েছে আউশগ্রাম থানায়।” এফআইআরে সুকুমার সাহা গোষ্ঠীর কয়েকজনের নামও রয়েছে। অভিযুক্তদের খুঁজছে পুলিশ।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy