সারা বছর নিকাশির জল জমে থাকে এখানে। ছবি: উদিত সিংহ।
বর্ষায় কুনর নদীর জল বাড়লেই ঘুম উড়ে যায় এ শহরের।
দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে নিকাশি ব্যবস্থার হাল ফেরাতে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হচ্ছে বলে শুনে আসছেন বাসিন্দারা। কিন্তু লাল জমানা গিয়ে সবুজ দিন এলেও হাল ফেরেনি নিকাশির। ফলে আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকেই বিরহ, কবিতা শিকেয় তুলে ঘর সামলাতে লেগে পড়েন বাসিন্দারা। হাঁটু জলে পা ডুবিয়ে কাজকর্ম, স্কুল-কলেজ চলে। নোংরা জলের সঙ্গে আসে অসুখ-বিসুখও।
গুসকরার ক্ষেত্রপাল পাড়ার বাসিন্দা তিমিরবরণ চাঁদের দাবি, “গোটা পুরসভায় নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছুই নেই। সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু জল জমে যায়। জল নামতে কয়েক ঘণ্টা।” তাঁর অভিযোগ, প্রতিটি ওয়ার্ডের নিকাশি ব্যবস্থা জমির ঢাল অনুসারে তৈরি না হওয়াতেই এই বিপত্তি। রেলপাড়ের বাসিন্দা সুমিত পাশওয়ান আবার বলেন, “ট্যাপকলের পয়েন্ট ধরে ধরে যত্রতত্র নর্দমা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই নর্দমার জল নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার কোনও ব্যবস্থা সেভাবে করা হয়নি। ফলে সব সময়েই শহরের কোনও না কোনও অংশ জলে অবরুদ্ধ থাকে।” এলাকায় গিয়েও দেখা যায়, এই শুকনো শীতেও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের রেল লাইনের পাড় বা ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আলুটিয়া এলাকার রাস্তা কাদায় ভরা। পুরসভা কিছুটা অংশে ড্রেন তৈরি করে দিলেও বাকি রাস্তায় সেই নোংরা জল উপচে পড়ছে। ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, “জল, কাদা নিয়েই আমাদের সারা বছরের সংসার।”
গুসকরা শহরটি বর্ধমান-সাঁইথিয়া রেললাইনের দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। এই লাইনও অনেক নিকাশি নালাকে আটকে দিয়েছে বলে অনেক বাসিন্দার দাবি। তাঁরা জানান, যেহেতু ওই রেললাইন তুলনায় উঁচু তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই রেললাইন সংলগ্ন ওয়ার্ডগুলি ডুবে যায়। বর্ষায় ট্রেনে যেতে যেতেই দেখা যায়, দোনাইপুর, বিহারী পট্টি, লাইনপার, স্টেশন বাজার, শান্তিপুর, ধারাপাড়া ইত্যাদি জায়গার ঘরবাড়ি ঘিরে জল জমে রয়েছে। এই জমা জল পাম্প করে শহরের বাইরে ইটাচাঁদার খালে ফেলার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ কেন হল না, জানেন না বাসিন্দারা।
কিন্তু এতদিনের সমস্যা মেটাতে সিপিএমের পুরবোর্ড বা তারপরে তৃণমূল কোনও উদ্যোগই কী করেনি? সিপিএমের শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক আলমগির মণ্ডলের দাবি, “গুসকরা শহরের আকার অনেকটা গামলার মতো। তাই কুনুরের চেয়ে যে ওয়ার্ডগুলি নিচে সেখানে জল বের হতে পারে না।” তাঁর দাবি, ইটাচাঁদার কাছে বড় নিকাশি নালা তৈরি করে ওই জমা জল খড়ি নদীতে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকরী হয়নি। এ ছাড়া বাসস্ট্যান্ডের পিছনে জল জমে যে জলাশয় তৈরি হয়েছে সেই জল শান্তিপুর দিয়ে খাল কেটে বলগনা মোড় দিয়ে খড়ি নদীতে ফেলারও পরিকল্পনা করা হয়েছিল এক সময়। কিন্তু টাকার অভাবে সেই মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করা যায় নি। বামেদের দাবি, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা গেলে নর্দমার জলই নয়, শহরে ঢুকে পড়া কুনুরের জলও বের করে দেওয়া যেত।
বাম আমলের এই ব্যর্থতার কথা তুলেই ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। তৃণমূলের পুরবোর্ডের প্রথম পুরপ্রধান চঞ্চল গড়াইয়ের মতে, সিপিএমের আমলে শহর জুড়ে অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ি তৈরির মাসুল আজ দিতে হচ্ছে গুসকরাকে। তাঁর দাবি, নিচু জায়গায় একের পর এক পাকা বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ড্রেনের জল বের হওয়ার জায়গা রাখা হয়নি। চঞ্চলবাবুর দাবি, “ ক্ষমতায় এসে যখন নিকাশি নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করেছিলাম তখন মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সমীক্ষা করা হয়েছিল। মানুষের হাতে পায়ে ধরেও ড্রেন করার মতো জায়গা মেলেনি। তবে বড় নর্দমা করে বাসস্ট্যান্ডের জল বলগোনা মোড় থেকে কুনুরে ফেলার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা বজায় রয়েছে।”
গুসকরার এক বাম নেতা বিনোদ চৌধুরী বলেন, “বলগোনা মোড়ে যে কালভার্টটি রয়েছে সেটি উঁচু করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। সেখান দিয়ে জল বের কররা একটি ফাঁক রয়েছে। ওই ফাঁকের সংখ্যা বাড়াতেও বলা হয়েছিল পূর্ত সড়ক দফতরকে। কিন্তু তৃণমূল আর এ ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি।”
আর বর্তমান পুরপ্রধান তৃণমূলের বুর্ধেন্দু রায়ের দাবি, “বাসস্ট্যান্ডের কাছে জমা জল শহরের পক্ষে সত্যিই ক্ষতিকর। মাছি-মশার উৎপাতও বাড়ছে। ওই নোংরা জলে অনেক জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার অভিযোগও পাচ্ছি।” তাঁর দাবি, “নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যানের প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরির জন্য ই-টেন্ডার ডাকা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে আমরা রাজ্য পৌর দফতরের সঙ্গে কথা বলে টাকা চাইব।” বুর্ধেন্দুবাবুর দাবি, “মোটামুটি ১ কোটি টাকা লাগবে এই প্রকল্পে। নিকাশি নালা তৈরির জন্য অনেক জমিও কিনতে হবে।”
তবে রাজনীতির তরজার বাইরে সাধারণ মানুষের কথা একটাই, বারবার মাস্টার প্ল্যানের কথা ওঠে, আবার হারিয়ে যায়। গুসকরা নর্দমার জলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েই থাকে।
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে
আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর গুসকরা’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
বর্ধমান বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy