এই তথ্যপ্রযুক্তি পার্কেই বুধবার রাতে তাণ্ডব চলে বলে অভিযোগ।—নিজস্ব চিত্র।
তালিকাটা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে।
কখনও স্থানীয়দের নিয়োগের দাবিতে শিল্প সংস্থায় তাণ্ডব, কখনও ব্যক্তিগত বিবাদে নাক গলিয়ে মারধর, কখনও আবার হাসপাতালের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভগত সাড়ে তিন বছরে নানা সময়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ দুর্গাপুর। বুধবার গভীর রাতে শহরের তৃণমূল কাউন্সিলর ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি পার্কের কর্মীদের মারধরের অভিযোগ ওঠার পরে সে নিয়ে ফের সরব হয়েছে নানা বণিক সংগঠন ও বিরোধীরা।
দুর্গাপুরে একের পর এক এই ধরনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে শাসকদলের নানা নেতার। কেউ জোরজুলুম করলে দল তা বরদাস্ত করবে না, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব নানা সময়ে এমন বার্তা দিলেও এই শিল্প শহরে তেমন ঘটনার বিরাম নেই। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দুর্গাপুরের নমো সগড়ভাঙায় জয় বালাজির ইস্পাত কারখানার প্রশাসনিক ভবনে জোর করে ঢুকে আধিকারিকদের বৈঠক ভেস্তে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দুর্গাপুর ৩ নম্বর ব্লক যুব তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি অসীম প্রামানিক। ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে আধিকারিকদের আটকে রাখা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। সেই রাতেই কারখানার জেনারেল ম্যানেজার পদমর্যাদার এক আধিকারিক নিজের আবাসনে কয়েক জন দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হন। এর পরে কারখানা গোটানোর হুমকি দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। অসীমবাবুরর বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের হয়েছিল।
ওই ঘটনার পরপরই বিধাননগরে এক বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভ করে কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত করার অভিযোগ উঠেছিল অসীমবাবুর বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগ বারবার উঠতে থাকায়া শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের মার্চে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। কিন্তু, শাসকদলের নেতা-কর্মীদের তাণ্ডব বন্ধ হয়নি।
২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর ডিপিএলে কিছু আইএনটিটিইউসি কর্মী তাদের নেতা দেবদাস মজুমদারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির দাবিতে সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের (এমডি) ঘরের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে তাঁকে হেনস্থা করেন বলে অভিযোগ। কারখানা কর্তৃপক্ষ সেই ঘটনার বিভাগীয় রিপোর্টও পাঠান রাজ্যের বিদ্যুৎ মন্ত্রী ও সচিবের কাছে। তবে পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ হয়নি। সেই বছরই ডিসেম্বরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিধাননগরের সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকের সঙ্গে অভব্য আচরণ ও ভাঙচুরের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দেবদাসবাবুর বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের ৩ জুলাই তৃণমূলের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন সভাপতি খোকন রুইদাসের বিরুদ্ধে দলেরই বিধায়ক তথা এডিডিএ-র চেয়ারম্যান নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও পুলিশের কাছে সিন্ডিকেট চালানো এবং আরআইপি শিল্পতালুক ও মুচিপাড়া বাজারে তোলাবাজির অভিযোগ জানান। তখন অবশ্য পুলিশ বা তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্ব অভিযুক্ত নেতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। পরে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে খোকনবাবুকে গ্রেফতার করা হয়। সম্প্রতি তাঁকে ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে দল।
মাস কয়েক আগে ফরিদপুর এবং দুর্গাপুরের দু’টি কাগজকল কর্তৃপক্ষও তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের নামে জবরদস্তির অভিযোগ তোলে। ফরিদপুরের প্রতাপপুরের নির্মীয়মাণ কাগজকলটি নিয়োগের দাবিতে জোরজুলুমের অভিযোগে কাজ বন্ধের নোটিসও ঝুলিয়ে দেয়। তৃণমূলের দু’টি পক্ষ ছাড়াও সিপিএম এবং এসইউসি-র স্থানীয় নেতাদের দিকে আঙুল তুলেছিলেন ওই কাগজকল কর্তৃপক্ষ।
পুজোর আগে বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে কারখানায় ঢুকে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কাউন্সিলর অরবিন্দ নন্দীর বিরুদ্ধে। রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুুর শিল্পতালুকে একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানায় ওই কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এক দল লোক ঢুকে কর্মী-আধিকারিকদের মারধর করেন ও ভাঙচুর চালান বলে অভিযোগ। কয়েক দিন আগে জমি নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার বিবাদে নাক গলিয়ে ফুলঝোড়ে এক প্রাক্তন সেনাকর্মীকে মারধর ও হুমকিতে নাম জড়ায় তৃণমূল কাউন্সিলর দীপঙ্কর লাহার।
বারবার এমন ঘটনায় রীতিমতো বিরক্ত বণিক সংগঠনগুলির কর্তারা। ‘দুর্গাপুর স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক কৃপাল সিংহের কথায়, “যেভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, লগ্নিকারীদের জন্য তা মোটেও স্বস্তির নয়। আমরা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছি।” ‘বেঙ্গল সাবার্বান চেম্বার অফ কমাসর্’-এর সাধারণ সম্পাদক প্রফুল্ল ঘোষের বক্তব্য, “শিল্প বা লগ্নির জন্য এ সব ঘটনা অশনি সঙ্কেত। শুধু আর্থিক ক্ষেত্রে নয়, এমন ঘটনার প্রভাব পড়ছে সামাজিক ক্ষেত্রেও।”
দুর্গাপুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর দাবি, “এমনিতেই রাজ্যে নতুন লগ্নি প্রায় নেই। তার উপরে একের পর এক শিল্প সংস্থায় গুন্ডামির ঘটনা ঘটছে। শুধু দুর্গাপুর নয়, রাজ্য জুড়েই এমন ঘটছে। তথ্যপ্রযুক্তি পার্কও রেহাই পাচ্ছে না। রাজ্যের মানুষের স্বার্থে অবিলম্বে পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া দরকার।” দুর্গাপুরের বিজেপি নেতা অখিল মণ্ডল আবার বলেন, “রাজ্যের উন্নয়ন স্তব্ধ হচ্ছে গুন্ডামির চোটে। তা থেকে যে তৃণমূল কোনও শিক্ষা নিচ্ছে না, বারবার এই ধরনের ঘটনা থেকেই তা পরিষ্কার।”
তৃণমূলের জেলা (শিল্পাঞ্চল) সভাপতি তথা দুর্গাপুরের মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “দলের উচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী, যে বা যারা জোরজুলুম করবে, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy