Advertisement
E-Paper

প্রাণ বাঁচাতে গিয়েই প্রাণ হারালেন ‘হেল্পার’

ঠুনকো রেলিঙের ঠেকায় ঝুলছে বাস। বেগতিক দেখে চালক পালিয়ে গেলেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর আটান্নর রোগা-পাতলা শরীরটা। যাত্রীদের আশ্বস্ত করে একে একে বাসের দরজা দিয়ে বের করে দিচ্ছে একটানা।

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২৭
ঘটনার পড়ে ভিড় নুনিয়া নদীর ওই সেতুতে। —নিজস্ব চিত্র।

ঘটনার পড়ে ভিড় নুনিয়া নদীর ওই সেতুতে। —নিজস্ব চিত্র।

ঠুনকো রেলিঙের ঠেকায় ঝুলছে বাস। বেগতিক দেখে চালক পালিয়ে গেলেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বছর আটান্নর রোগা-পাতলা শরীরটা। যাত্রীদের আশ্বস্ত করে একে একে বাসের দরজা দিয়ে বের করে দিচ্ছে একটানা।

শেষ যাত্রী নেমে যেতেই বোধহয় একটু হাসি ফুটেছিল ঠোঁটে। নিজে নামতে বাসের পাদানিতে সবে পা রেখেছেন, ওমনি বিকট শব্দে রেলিঙের আগল ভেঙে ১০০ মিটার নীচে নুনিয়া নদীতে পড়ে গেল বাসটি। ঘরে ফেরা হল না ওই রোগা-পাতলা শরীরটার মালিক অশোক দে-রও।

শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই শিল্পাঞ্চলে চর্চা চলছিল এই ঘটনার। নুনিয়া নদীর সঙ্গে অশোকবাবুর সাহসের সাক্ষী ছিলেন কয়েকশো মানুষও। তাঁরাই দুমড়ে যাওয়া মিনিবাসটির মধ্যে থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করেন অশোকবাবুকে। নিয়ে যান আসানসোল জেলা হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হলেও প্রাণ হারান তিনি।

শুক্রবার সকালের এই হাড়হিম করা ঘটনায় একজনের মৃত্যু হলেও কার্যত যমের দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন বাকিরা। এলাকার বাসিন্দাদের একটাই কথা, বাসের চালকের মতো ওই হেল্পারও যদি পালিয়ে যেতেন তাহলে নুনিয়ার গর্ভেই প্রাণ যেত জনা পনেরো যাত্রীর। রানিগঞ্জের বল্লভপুরের বাসিন্দা অশোকবাবুর পরিবারেও শোক আর গর্ব পাল্লা দিচ্ছে। মেজিয়া শ্মশানঘাটে দাঁড়িয়ে অশোকবাবুর দাদা সুকুমার দে জানান, হতদরিদ্র পরিবারের জোয়াল কাঁধে নিয়েও ভাই সবসময় কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন। যখনই যে কাজে নামতেন সেটা শেষ করে ছাড়তেন। এ দিনও বাস যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে নিজের জীবনের মূল্য চুকিয়েছেন। সুকুমারবাবু বলেন, “রাতেও আমাকে জানিয়েছিল কত নম্বর বাসে ডিউটি করতে যাবে। তখনও বুঝিনি ও আর ফিরবে না।”

দুপুর ২টো নাগাদ বাস মালিকের ফোনে ঘটনার কথা জানার পরেই স্তব্ধ হয়ে যায় অশোকবাবুর পরিবার। নিজের জীবন দিয়ে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর ঘটনা শুনে ভিড় করতে থাকেন পড়শিরাও। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অশোকবাবুর স্ত্রী গীতাদেবী বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। চোখের জল সামলে ছেলে, পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি রবি বলেন, “বাবা সবসময় বলতেন ক্ষুদ্র হোক তবু নিজের কাজে ন্যায়নিষ্ঠ থাকতে হবে। জীবনের শেষ দিনেও সেই শিক্ষা দিয়ে গেলেন।”

এমন একজন বাসকর্মীর জন্য বুক চওড়া হয়েছে বাসমালিক সংগঠনের কর্তাদেরও। আসানসোল মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুদীপ রায় বলেন, “আমাদের কর্মীরা ফের প্রমাণ করে দিয়েছেন তাঁরা যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টিই সবার আগে দেখেন।” সুদীপবাবু জানিয়েছেন, অশোকবাবুর পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি তাঁদের সংগঠন খুবই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। এই বাসকর্মীর মৃত্যু কার্যত পরিবহন শিল্পে একটি উদাহরণ হয়ে থাকল বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারাও।

এ দিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ অশোকবাবুর দেহ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়িতে। জলোচ্ছাসের মতো গোটা গ্রাম যেন ভেঙে পড়ে বাড়ির দাওয়াই। স্থানীয়রা জানান, এলাকার যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলোই হাসিমুখে যোগ দিতেন অশোকবাবু। শুধু বাসের নয়, সকলেরই ‘হেল্পার’ ছিলেন তিনি।

পড়ন্ত বিকেলের আলোয় সবার চোখের জলে যেন চকচক করে ওঠে অশোকবাবুর রোগাপাতলা শরীরটা।

bus accident nunia river asansol
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy