মাসের পর মাস মেলা বসে খেলার মাঠে।
কল-কারখানার যখন রমরমা ছিল, শহরের ছবিটা তখন ছিল বেশ উজ্জ্বল। অন্য সমস্ত কিছুর মতোই তখন সকাল-বিকেল গমগম করত দুর্গাপুরের নানা খেলার মাঠ। ফুটবল থেকে বক্সিং বা বাস্কেটবল, দুর্গাপুরে কৃতী ক্রীড়াবিদের অভাব ছিল না। কিন্তু শিল্পের পরিস্থিতি যত রুগ্ণ হয়েছে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় যত ঝাঁপ পড়েছে, খেলাধুলোর সেই সব দিনও যেন চলে গিয়েছে অন্ধকারে।
এক সময়ে এই শহর থেকে বহু ফুটবলার দাপিয়ে খেলেছেন কলকাতার ময়দানে। রাজ্য ও জাতীয় স্তরের বক্সিং, ভলিবল, বাস্কেটবলে প্রতিনিধিত্ব করেছে শহরের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু এখন সেই স্তরে শহরের কোনও প্রতিনিধিকে দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। শহরে মোহনবাগান ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। ওই অ্যাকাডেমি থেকে কেউ-কেউ জায়গা করে নিয়েছেন কলকাতার বড় ক্লাবে। কিন্তু তাঁরা কেউই দুর্গাপুরের নন।
এক সময়ে মোহনবাগানের হয়ে ফুটবল খেলেছেন এই শহরের স্বপন সাহা, সমীর বসুরা। ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিংয়ে খেলতেন অমিতাভ ঘোষ। মোহনবাগান, মহামেডানে খেলেছেন অশোক চক্রবর্তী। কলকাতার বড় দল পাশাপাশি জাতীয় জুনিয়র দলেও খেলেছেন গৌতম দে। বড় দলে নিয়মিত খেলা ছাড়াও সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন সঞ্জয় মাঝি। রাজ্য ও জাতীয় স্তরে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, দুর্গাপুরের এমন বক্সারের সংখ্যাও কম নয়। জাতীয় গেমসে সোনাজয়ী রমেশ বাসনেট, ব্রোঞ্জজয়ী মিমি বাসনেট বা আর্ন্তজাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করা ভরত রাই, এজাজ আলম, রাজেশ বাসনেটসবাই দুর্গাপুরের। বক্সিংয়ে জাতীয় কোচ হয়েছিলেন এই শহরের অঞ্জন মিত্র। বাস্কেটবলে দেশের হয়ে খেলেছেন প্রদীপ তিওয়ারি। জাতীয় কোচ হয়েছিলেন বিতান বসু। ভলিবলে টিপি গোপালন সিনিয়র বেঙ্গল, জাতীয় দলে খেলেছেন। জাতীয় যুব দলে ভাস্কর গুহ, সিনিয়র বাংলা দলে সিদ্ধার্থ বসু, বসন্ত সাহারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ক্রীড়াপ্রেমীদের আক্ষেপ, সেই ধারায় ছেদ পড়েছে অনেক দিনই।
ফুটবলের গরিমা বজায় রাখতে এগিয়ে এসেছিল মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা। সেটা ১৯৮৮ সাল। শহরে ফুটবলের প্রসার ও প্রতিভা খুঁজে ঘষামাজা করার উদ্দেশে ‘দুর্গাপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা’ তত্কালীন ‘দুর্গাপুর নোটিফায়েড এরিয়া অথরিটি’র আর্থিক সহযোগিতায় শহরে ১৬টি সাব জুনিয়র ফুটবল প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে। পাশাপাশি রাজ্যের প্রথম সাব জুনিয়র ফুটবল লিগও চালু হয় দুর্গাপুরে। শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে লিগে খেলার সুযোগ থাকায় উত্সাহী হয়ে ওঠেন বাবা-মায়েরা। খুদেদের তাঁরা শিবিরে পাঠাতেন। তাঁরা চাইতেন, পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবলেও ছেলে যেন চৌখস হয়ে ওঠে। সেই সময়ে শহরের নানা শিল্প সংস্থায় খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পাওয়ার সম্ভবনা ছিল। তাই শুধু পড়াশোনা নয়, খেলেও যে ‘কেরিয়ার’ গড়া যায়, তা মাথায় রাখতেন অভিভাবকেরা।
তখন খেলোয়াড় কোটায় নিয়োগের পাশাপাশি খেলাধুলোর প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পরিস্থিতি। খনির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা এমএএমসি ১৯৯২ সালে চলে যায় বিআইএফআর-এর অধীনে। ২০০১ সালে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। অথচ, এমএএমসি স্টাফ ক্লাবের সবুজ মাঠে কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি, মইদুল ইসলাম, তরুণ দে, কুলজিত্ সিংহদের খেলা এখনও কারখানার পুরনো কর্মীদের চোখে ভাসে। কলোনির মাঠে নঈম, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, রাজা মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়েরা কলোনির মাঠ মাতাচ্ছেন, সে ছবি আজও যেন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা এইচএফসিএল-এর প্রাক্তন কর্মীরা। ১৯৯৮ সালে কারখানা চলে যায় বিআইএফআর-এর অধীনে। ২০০৩ সালে পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় এইচএফসিএল। চশমার বাইফোকাল লেন্স, ফিল্টার গ্লাস, অপটিক্যাল লেন্স প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিওজিএল-ও ১৯৯২ সালে বিআইএফআর-এ চলে যায়। ২০০৩ সালে উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায়। আটের দশকের শেষ দিকে আর্থিক দুর্দশায় ভুগতে থাকে শহরের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট (ডিএসপি)। এ ভাবে একের পর এক সংস্থাগুলির হাল খারাপ হতে থাকায় শহরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়। খেলোয়াড় কোটায় নিয়োগের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তার জেরে কিছুটা হলেও খেলাধুলোয় আগ্রহ কমতে থাকে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় সাব-জুনিয়র ফুটবল লিগ। পরের বছর বন্ধ হয়ে যায় প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিও।
ভগত্ সিংহ স্টেডিয়াম।
বছর দু’য়েক পরে আবার লিগ চালু করার উদ্যোগী হয় মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা। ২০০০ সাল নাগাদ সাব-জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৫) ও জুনিয়র (অনূর্ধ্ব ১৯) বিভাগে লিগ চালু হয়। এ ছাড়া সুপার ডিভিশন, প্রথম ডিভিশন, দ্বিতীয় ডিভিশনের লিগ চলছে। কিন্তু আগের সেই আগ্রহ-উন্মাদনা আর দেখা যায় না। সেলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ২০০৩ সালে মোহনবাগান দুর্গাপুরে নিজস্ব ফুটবল অ্যাকাডেমি খোলে। কিন্তু সেখানেও দুর্গাপুরের ছেলের সংখ্যা নগণ্য। অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি তপন রায় জানান, ৪২ জনের মধ্যে মাত্র ৫ জন দুর্গাপুরের। বাকিরা সবাই অন্য জায়গা থেকে এসেছেন।
তবে আশা ছাড়তে রাজি নয় মহকুমা ক্রীড়া সংস্থা। শহরের খেলাধুলোর হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে নানা ভাবে চেষ্টা চলছে বলে জানান সংস্থার কর্তারা। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক বিধান মজুমদার জানান, ফুটবলের সাব জুনিয়র পর্যায়ের দশটি প্রশিক্ষণ শিবির চলছে। ক্রিকেট, ভলিবল, হকি, বাস্কেটবলের বিভিন্ন পর্যায়ের লিগ আয়োজিত হয় প্রতি বছর। ক্রিকেটের ৫টি, ভলিবল এবং বাস্কেটবলের দু’টি করে প্রশিক্ষণ শিবিরও চালু করা হয়েছে। সুদিন ফেরার ব্যাপারে আশা হারাচ্ছেন না, জানান তাঁরা।
ছবি: বিশ্বনাথ মশান।
(চলবে)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বর্ধমান’। প্রতিক্রিয়া জানান www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বর্ধমান বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy