Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সুরক্ষা নিয়ে নজরদারি কই, প্রশ্ন ডিএসপি-তে

দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষে মাস ছয়েক আগে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছিলেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট (ডিএসপি) কর্তৃপক্ষ। রবিবারের রাতের ঘটনা সে সব নিয়েই পাল্টা প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল। নিতান্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস মুখোশ ছাড়াই ব্লাস্ট ফার্নেস পরিষ্কার করার কাজে গিয়েছিলেন দুই ঠিকা শ্রমিক। বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে কার্যত কয়েক ঘণ্টা ধরে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৫২
Share: Save:

দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষে মাস ছয়েক আগে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছিলেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট (ডিএসপি) কর্তৃপক্ষ। রবিবারের রাতের ঘটনা সে সব নিয়েই পাল্টা প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিল। নিতান্ত প্রয়োজনীয় গ্যাস মুখোশ ছাড়াই ব্লাস্ট ফার্নেস পরিষ্কার করার কাজে গিয়েছিলেন দুই ঠিকা শ্রমিক। বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে কার্যত কয়েক ঘণ্টা ধরে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। একটি লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত কারখানায় এমন ঘটনার পরে শ্রমিক-নিরাপত্তার হাল সামনে এসে গিয়েছে বলে দাবি করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলি।

ডিএসপি-র ৩ নম্বর ব্লাস্ট ফার্নেস পরিষ্কার করতে গিয়ে রবিবার সন্ধ্যায় বিষাক্ত গ্যাসে অচেতন হয়ে পড়েন ঠিকা শ্রমিক সন্ন্যাসী গোপ (৩০) ও শ্যামাপদ বাউড়ি (৩৪)। কয়েক ঘণ্টা পরে তাঁদের উদ্ধার করে ডিএসপি হাসপাতালে পাঠালে রাতে চিকিৎসকেরা তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।

২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর কোকওভেন প্ল্যান্টে গাইড কার ও কোক কারের গতিবিধি আগাম আঁচ করতে না পেরে এক ঠিকা শ্রমিক তলায় চাপা পড়ে মারা যান। দুই ঠিকা শ্রমিক জখম হন। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ২ নম্বর ব্লাস্ট ফার্নেসে বিষাক্ত গ্যাস (নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সিজেনের মিশ্রণ) লিক করে ২৫ জন কর্মী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সপ্তাহখানেক পরে সবাই সুস্থ হন। স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-র সূত্র অনুযায়ী, ২০১২ ও ২০১৩ সালে সাতটি করে দুর্ঘটনা ঘটেছিল ডিএসপি-তে। গড়ে বছরে এক জন করে কর্মী মারা গিয়েছিলেন। সেই তুলনায় চলতি বছরে রবিবারই প্রথম দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এক সঙ্গে মারা যান দুই ঠিকা শ্রমিক।

গত জুন মাসে ভিলাই ইস্পাত কারখানায় গ্যাস লিক করে অসুস্থ হয়ে ৫ কর্মী যান। তার এক সপ্তাহের মধ্যেই ডিএসপি-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক পঙ্কজকুমার সিংহ কারখানার বিভিন্ন বিভাগে কর্মী নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের নির্দেশ দেন, কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি, ডিএসপি কর্তৃপক্ষ শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন। কাজের সময় যে সমস্ত গাড়ি বা ট্রলি ব্যবহার করা হয়, সেগুলির গতি সীমিত করা, নিয়মিত গ্যাস পাইপলাইন পরীক্ষা, গ্যাস লিক হলে তা শনাক্ত করার ব্যবস্থা আরও জোরালো করা, উঁচুতে কাজের সময়ে নীচে জালের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, খোঁড়া জায়গার চারপাশে পাকা বেড়া দেওয়া, কারখানার ভিতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু রবিবার দু’জনের মৃত্যু বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ডিএসপি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২০ সেপ্টেম্বর দু’জনেরই নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ শেষ হয়। রবিবার চারটি ব্লাস্ট ফার্নেস পরিষ্কার করার কাজ হাতে নিয়েছিলেন ওই দু’জন। প্রথম দু’টি শেষ করার পরে বিকাল ৩টা নাগাদ তাঁরা ৩ নম্বর ব্লাস্ট ফার্নেসের কাছে পৌঁছন। সহকর্মী সরোজ রায়, যতীন ঘোষেরা তাঁদের খাওয়ার পরে নতুন করে কাজ শুরুর প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাঁরা তা শোনেননি। সহকর্মীরা ক্যান্টিনে চলে যান। মৃতদের সহকর্মীরা জানান, দু’জন গ্যাস মুখোশ ছাড়াই কাজে গিয়েছিলেন। যে সমস্ত কাজে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে গ্যাস মিটার নিয়ে কর্মীদের যাওয়ার কথা। তা-ও তাঁদের দেওয়া হয়নি। যে কাজ শেষ করে ফিরতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়, সেখানে তাঁরা যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফিরলেন না, তা-ও কেউ দেখার ছিলেন না। তাঁদের আরও দাবি, ৩ নম্বর ব্লাস্ট ফার্নেস লাগোয়া বাতাসে বিপজ্জনক গ্যাসের উপস্থিতি মাত্রা ছাড়ায় দুপুরেই। তা সত্ত্বেও দুই ঠিকা শ্রমিককে ব্লাস্ট ফার্নেস পরিষ্কারের কাজে যেতে কেউ বাধা দেননি।

ডিএসপি-র আইএনটিইউসি নেতা দেবাশিস চৌধুরী বলেন, “নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণই সব নয়। নিরাপত্তা বিধি ঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে ধারাবাহিক নজরদারি দরকার। ঠিকা কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পিছনে ডিএসপি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমান দায় থাকার কথা ঠিকাদার সংস্থারও। কিন্তু এ সব দেখার কেউ নেই।” সিটু নেতা সৌরভ দত্তের দাবি, “একের পর এক দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত গাফিলতি প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না।” আইএনটিটিইউসি নেতা হিমাংশু আশের বক্তব্য, “নিরাপত্তা খতিয়ে দেখতে ডিএসপি-র গড়া কমিটিতে শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি রাখার দাবি জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবও জানতে পারবেন কর্মীরা।” ডিএসপি-র তরফে জানানো হয়, দুই ঠিকা শ্রমিকের মৃত্যুর তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রবিবার রাত ৯টা নাগাদ কাঁকসার বাঁশকোপায় একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানার ব্লাস্ট ফার্নেসের গ্যাস লিক করে অসুস্থ হন প্রায় পনেরো জন কর্মী। কারখানা সূত্রে জানা গিয়েছে, রাতের পালিতে কাজ করছিলেন কর্মীরা। সেই সময় হঠাৎ ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে বিষাক্ত গ্যাস বেরোয়। প্রথমে বুঝতে পারেননি কর্মীরা। অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় পনেরো জন কর্মী। তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে কারখানার নিজস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ইএসআই হাসপাতালে, সেখান থেকে রাতের দিকে তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনকে বিধাননগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সোমবার সন্ধ্যায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারখানার পার্সোনেল ম্যানেজার দীপক সাউ বলেন, “ডাক্টাইল আয়রন পাইপে লিক হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। কী কারণে এমন হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE