দেশ জুড়ে এখন মহা শোরগোল। দিল্লিতে সংসদ চত্বর রোজ উত্তাল। কলকাতার পথে প্রতিবাদ, রাজনীতির অলিন্দে বিতর্ক তুঙ্গে। মামলা গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টেও। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) ঘিরে এই হইচইয়ের লেশমাত্র ছিল না দু’দশক আগে! এই বাংলাতেই বিশেষ সংশোধনে ভোটার তালিকা থেকে এক লপ্তে বাদ পড়েছিল ২৪ লক্ষ নাম!
বিহারে এসআইআর-এর প্রথম পর্ব শেষে খসড়া তালিকায় কাটা গিয়েছে ৬৫ লক্ষের বেশি নাম। এর পরে বাংলায় হবে এসআইআর, প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, বাংলায় ২০০২ সালে বিশেষ সংশোধনের পরে ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চার কোটি ৫৮ লক্ষ। ওই প্রক্রিয়ার আগে যে সংখ্যা ছিল চার কোটি ৮২ লক্ষ। অর্থাৎ বাদ পড়েছিল ২৪ লক্ষ। তখনও মৃত, স্থানান্তরিত ভোটারদের বাদ দেওয়ার কথাই বলা হয়েছিল কমিশনের তরফে। সংশোধনের জন্য সমীক্ষার কাজ চলেছিল ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। সেই সময়ের মধ্যে বড় কোনও বিতর্ক বা গোলমালের ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। তার পরে গঙ্গা দিয়ে বহু জলই গড়িয়েছে!
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরের বর্ষীয়ান সূত্রের মতে, তখনকার সঙ্গে এখনকার এসআইআর-এ তফাত মূলত দু’জায়গায়। প্রথমত, বাংলায় ওই সংশোধন হয়েছিল ২০০১ সালের বিধানাসভা নির্বাচন মিটে যাওয়ার কয়েক মাস পরে। ভোটের দিকে তাকিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে কারও নাম কেটে দেওয়ার ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে, এই অভিযোগ তোলার পরিবেশ তখন ছিল না। আর দ্বিতীয়ত, এখনকার মতো কাগজপত্রের ঝঞ্ঝাট সে যাত্রায় রাখা হয়নি। রেশন কার্ডের মতো সহজ স্বীকৃত নথি দিয়ে কাজ করা যেত। রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সব্যসাচী সেন অবশ্য ওই সময়ে কিছু জাল ভোটার পরিচয়পত্র ধরা পড়ার কথা জানিয়েছিলেন। সেই ঘটনায় খানিক চাপানউতোর ছিল রাজনৈতিক শিবিরে।
প্রবীণ প্রশাসনিক কর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলা ও বিহারে আগের এসআইআর-এর সময়েও কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার। বাংলায় যেমন ২০০১-০২ সালের এসআইআর-এর পরে ২০০২ সালের ভোটার তালিকাকে এ বারের সংশোধনে ভিত্তি ধরতে চলেছে কমিশন, বিহারে তেমনই ধরা হয়েছে ২০০৩ সালের তালিকা। ঘটনাচক্রে, দু’দশক আগে এসআইএর-এর পরে প্রথম বড় নির্বাচনে দুই রাজ্যেই ভরাডুবি হয়েছিল এনডিএ জোটের! বাংলায় ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ-র হয়ে একমাত্র আসন জিতেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিহারে সেই লোকসভা ভোটে ৪০ আসনের মধ্যে ২৯টি জিতে নিয়েছিল লালুপ্রসাদের নেতৃত্বাধীন জোট।
ঘটনাক্রম সাজালে দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জনগণনার পরে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়া ও বীরভূমে জনসংখ্যার হারে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ধরা পড়ে। অনুপ্রবেশের অভিযোগে সরব ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়ে দেন, সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপও ঢুকছে কি না, নজর রাখা হচ্ছে। সন্ত্রাসের প্রশ্নে কড়া হাতে মোকাবিলা হবে। তাঁর পাশে দাঁড়ান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং এআইসিসি-র তরফে প্রধান মুখপাত্র জয়পাল রেড্ডি। এরই পাশাপাশি, বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপরে অত্যাচারের কিছু অভিযোগ ওঠে। বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে চলে আসে ১৩২টি হিন্দু পরিবার। বামফ্রন্ট সরকার কেন ‘শরণার্থী’দের সহায়তা করবে না, প্রশ্ন তুলে মমতার ডাকে মিছিল হয় ২০০১ সালের ১৮ নভেম্বর।
এরই মধ্যে চলছিল ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ। আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে এসইউসি রাজ্যে বন্ধের ডাক দিয়েছিল ২০০২ সালের ১০ জানুয়ারি। তৃণমূল সেই বন্ধ সমর্থন করে। আবার মমতাও ওই সব অভিযোগে জেলায় জেলায় ‘জেল ভরো’ আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু এই প্রতিবাদের বিষয়ের মধ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনের কথা তখন সামনে আসেনি। সন্ত্রাস মোকাবিলার বিশেষ আইনের প্রতিবাদে নামায় মমতার সঙ্গে বরং তাঁর দলে তৎকালীন ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতা অজিত পাঁজার বিরোধ ছিল। আর এ সবের পরে ২০০২ সালের ২২ জানুয়ারি কলকাতা শহরে আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রে জঙ্গি হানার ঘটনা সব নজর সে দিকেই টেনে নেয়।
সংশোধন চলাকালীন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব জেলাশাসকদের নিয়ে কোনও বৈঠক করেননি, বুথ লেভল অফিসারদের (বিএলও) উদ্দেশে কোনও বার্তাও দেননি। প্রশাসনে বুদ্ধ এবং সিপিএমে অনিল বিশ্বাস জুটি পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন অঙ্ক কযে। কমিশনের সংশোধন প্রক্রিয়ার মূল খেলা যে হেতু বুথ স্তরে হয়, সাংগঠনিক ভাবে সে সময়ে শাসক এবং শক্তিশালী সিপিএম বুথেই নজর রেখেছিল। সিপিএমের বর্ষীয়ান নেতা রবীন দেবের কথায়, ‘‘এখন যেমন ২০০২ বা ২০০৩ সালের তালিকাকে ভিত্তি ধরা হচ্ছে, তখন সে রকম কিছু ছিল না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সমীক্ষা হয়েছিল। কোনও গোলমাল হয়নি।’’ প্রয়াত বুদ্ধের প্রতিবেশী, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জে এম লিংডোর সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছিলাম, কমিশন কোনও ভিত্তিবর্ষ ধরবে কি না। নথিপত্র নিয়ে সাধারণ মানুষকে সমস্যায় না-ফেলার অনুরোধও জানিয়েছিলাম।’’
এখন সময় বদলে গিয়েছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক এসআইআর-কে আখ্যা দিয়েছেন ‘সাইলেন্ট ইনভিজ়িবল রিগিং’! দলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের মতে, ‘‘ভোটার তালিকায় সংশোধন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। নতুন হচ্ছে, এমন নয়। কিন্তু এ বার সেই প্রক্রিয়ার আড়ালে হাজার হাজার ভোটারকে বাদ দিয়ে বিজেপির রাজনৈতিক সুবিধা করতে ষড়যন্ত্র চলছে বলে আমাদের আশঙ্কা।’’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পাল্টা মত, ‘‘মৃত, অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গা এবং জাল নথি নিয়ে ভুয়ো ভোটার বাদে কারও আশঙ্কার কারণ নেই। এসআইআর আগেও হয়েছে, আগেও নাম বাদ গিয়েছে। এখন ভোট-ব্যাঙ্কের জন্য বিরোধিতা হচ্ছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)