পরিচয়, পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়ি ছেড়ে দূরদূরান্তে মেহনত করেন, যাতে পরিবারের সকলে খেতে পায়। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেও নিজের দেশে মার খেতে হয়, ভাবতে পারেননি জুয়েল শেখ, আশিক মহম্মদেরা। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে জুয়েলের। তাঁরই আর এক সঙ্গী আশিক বাড়ি ফিরলেন ভাঙা পা আর গায়ে কালশিটে নিয়ে।
গত বুধবার জুয়েলকে যেখানে মারধর করা হয়, তার কিছু ক্ষণ পরে অনতিদূরে প্রহৃত হন আশিক। শনিবার পরিবারকে কাছে পেয়ে সেই যুবক বলছেন, ‘‘মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি না তো!’’ আশঙ্কা হয়েছিল, চেনা মুখগুলি হয়তো আর দেখতে পাবেন না।
ওড়িশার সম্বলপুরের শান্তিনগর থানা এলাকা। ঘড়ির কাঁটায় সে দিন রাত ৮টা। ভাড়াবাড়ি থেকে আশিক বেরিয়েছিলেন সব্জি কিনতে। তার পরেই শরীর জুড়ে কালশিটে পড়ে। ভাঙে হাড়। কী নিয়ে এমন অশান্তি হল? আনন্দবাজার ডট কম-কে আশিক বলেন, ‘‘আমি, আমার সঙ্গে ভাড়াবাড়িতে থাকা আরও ন’জন সঙ্গী সে দিন বাজার করতে বেরিয়েছিলাম। আমি যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে জুয়েলের ভাড়াবাড়ির দূরত্ব হাঁটাপথে মেরেকেটে ১০ মিনিট। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, তিনটি বাইকে ৬ জন লোক এসে আমাদের রাস্তা ঘিরে দাঁড়াল। তবে ওদের মুখ দেখতে পাইনি। কারণ, মাস্কে ঢাকা ছিল। আর কপালে তিলক ছিল।’’ আশিক বলে যান, ‘‘প্রথমেই বলল, আমাদের আধার কার্ড দেখাতে। কে, কী ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতেই ওরা বলাবলি শুরু করল, ‘‘ও, এরা তো বাংলাদেশি। মার।’’
আচমকা এমন আক্রমণের জন্য কে-ই বা তৈরি থাকে। আশিকরাও প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর সঙ্গীরা জোর গলায় কিছু বলার সুযোগ পাননি। বরং মারের হাত থেকে বাঁচতে যে যে দিকে পারেন দৌড় দেন। আশিকের দাবি, তিনি পালাননি। বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তিনি ওড়িশার স্থানীয় বাসিন্দা না হলেও এ দেশেরই নাগরিক। তাঁর কথায়, ‘‘ভয় পেলেও সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমরা কেউ বাংলাদেশের বাসিন্দা নই। অবৈধ ভাবে ঢুকিওনি।’ কিন্তু এক জন দৌড়ে এসে মারতে উদ্যত হল। বলল, ‘চল, জয় শ্রীরাম বল।’ ওদের বললাম, ‘আমি মুসলিম ঘরের ছেলে, আমি জয় শ্রীরাম বলতে পারব না।’ ওই কথা শোনার পরেই যে যে ভাবে পারল মার শুরু করল। চড়-থাপ্পড় কিছুই বাদ গেল না।’’
আরও পড়ুন:
আশিক জানান, বেগতিক দেখে তিনি ভেবেছিলেন পরিচয়পত্র দেখিয়ে এই ঝামেলা থেকে রক্ষা পাবেন। পকেটে মানিব্যাগ ছিল। মার খেতে খেতে কোনও রকম সেটা বার করে আধার কার্ড খুঁজছিলেন। কিন্তু কোথায় কী, সেই কার্ড দেখে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন আক্রমণকারীরা। পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, ‘‘আমি তো ওড়িয়া বলতে পারি না। তবে বুঝতে পারি। এত দিন ওখানে কাজ করছি। ওদের কথা শুনে বুঝলাম, কিছু ক্ষণ আগেও এক জনকে (জুয়েল) মেরেছে।’’ কী বলছিলেন? আশিক বলেন, ‘‘ওরা ওড়িয়া বলছিল, একটু আগে তো মুর্শিদাবাদেরই এক জনকে মেরে এসেছি। এটাকেও মার।’’ যুবকের অভিযোগ, এর পর আর চড়-থাপ্পড় নয়, এক জন লোহার রড বার করে এনে তাঁকে মারতে শুরু করেন। ছয় আগন্তুকের হাতে-পায়ে ধরেও নিস্তার মেলেনি। যত ক্ষণ তাঁদের ইচ্ছে হয়েছে, পিটিয়ে গিয়েছেন।
ওই অবস্থায় প্রায় দেড় ঘণ্টা রাস্তায় পড়েছিলেন আশিক। সঙ্গীরা উদ্ধার করতে এসেছিলেন। তাঁদের একজনের মোবাইল নিয়ে কোনও রকমে চাচার মোবাইল নম্বর টাইপ করেন। সংক্ষেপে যতটা জানানোর জানিয়ে দেন।
হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল আশিককে। ডাক্তার জানিয়েছেন, মোট তিনটে হাড় ভেঙেছে। শনিবার বাড়ি ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নির্মাণশ্রমিক আশিক। তিনি বলেন, ‘‘কয়েক মাস ধরেই শুনছিলাম বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের হেনস্থা করা হচ্ছে। সেটা যে আমার সঙ্গেও ঘটবে, কখনও ভাবিনি।’’
আর কখনও ওড়িশা যেতে চান না আশিক। বাড়ির লোকজনও ছাড়বেন না তাঁকে। যুবকের কথায়, ‘‘স্রেফ প্রাণটা বাঁচিয়ে ফিরতে পেরেছি। ভাবলে এখনও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ওই রাত কখনও ভুলব না। আমাদের সরকারের কাছে একটি অনুরোধ, এ রাজ্যে যেন খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো কাজ পাই। বাংলাদেশি অপবাদ নিয়ে আর কোথাও যেন মার খেতে না হয়।’’
অন্য দিকে, জুয়েলের মৃত্যুকাণ্ডে মুর্শিদাবাদের সুতি থানায় একটি এফআইআর রুজু হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে প্রতিবেশী রাজ্যে যাচ্ছে রাজ্য পুলিশের একটি দল।