Advertisement
E-Paper

জোড়া ফুল উপড়ে অর্ধেক জঙ্গলমহলে পদ্মের বন

বৃহস্পতিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছিল লালগড় হাইস্কুলের সামনে। বিনপুর-১ ব্লকের সব পঞ্চায়েতের গণনা হয়েছে এই স্কুলেই।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৮ ২২:১৪
বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস। নিজস্ব চিত্র

বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস। নিজস্ব চিত্র

৫ থেকে ৩২৯! বাংলার সবচেয়ে নতুন জেলা ঝাড়গ্রামের ৪১ শতাংশ গ্রামেই জোড়া-ফুলকে উৎখাত করে পদ্ম ফোটাল বিজেপি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে যে ঝাড়গ্রামে মাত্র পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেই জেলাতেই এই নির্বাচনে শাসক দলকে সমানে টক্কর দিয়ে অন্তত ২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজেপি। ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের এখনও ত্রিশঙ্কু। এর মধ্যে আরও ৩টি বিজেপির দখলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে বিজেপির আরও ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ৬০টি আসনে জয়ী বিজেপি-র প্রার্থীরা। খালি ঝাড়গ্রাম নয়, একই ছবি জঙ্গলমহলের বাকি দু’টি জেলা পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়াতেও।

গোটা রাজ্যে যখন শাসক দল কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে জঙ্গলমহলে এসে তৃণমূলের সেই বিজয়রথ হঠাৎ করেই থমকে গেল। যে জঙ্গলমহলের লাল মাটি থেকে ‘পরিবর্তন’-এর অভিমুখ তৈরি হয়েছিল, সেই লালমাটিতেই গেরুয়ার দাপাদাপি!

কোন ম্যাজিকে সম্ভব হল?

বৃহস্পতিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছিল লালগড় হাইস্কুলের সামনে। বিনপুর-১ ব্লকের সব পঞ্চায়েতের গণনা হয়েছে এই স্কুলেই।দুপুর গড়ানোর আগেই ঘোষণা হল সিজুয়া পঞ্চায়েতের ফল। দেখা গেল, মোট ১০টি আসনের মধ্যে ছ’টি বিজেপি-র দখলে। বাইরে অপেক্ষা করা বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল উল্লাস। ধামসা-মাদলের তালে তালে নাচ। কিন্তু কারা এই বিজেপি সমর্থক?

আরও পড়ুন: লাইভ: গ্রামবাংলা দখলে রাখছে তৃণমূল, দু’নম্বরে উঠে এল বিজেপি

ক’দিন আগেও যাঁদের গোটা এলাকা চিনত সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসাবে, এ দিন তাঁদেরকেই দেখা গেল পদ্মফুলের ঝান্ডা কাঁধে! ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাঁটাপাহাড়ি এলাকার বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতা, যাঁরা এক সময়ে লালগড় আন্দোলনের মুখ ছিলেন। পরবর্তীতে সেই নেতাদের হাত ধরেই লালগড়ের বুকে জোড়া-ফুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ততক্ষণে খবর আসছে, একের পর এক আসনে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গেরুয়া ব্রিগেড। কিন্তু, বাইরে দাঁড়ানো ওই ভিড়ে কোথাও কোনও আফসোসের চিহ্নমাত্র নেই। এঁদেরই একজন দীপক প্রতিহার। কাঁটাপাহাড়ির এই বাসিন্দা এখনও ওই এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা হিসাবে পরিচিত। তাঁর কথায়, “এখনও এলাকার মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে নয়। জনগণের এই রায় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে। এলাকা থেকে শুরু করে জেলা, রাজ্য নেতাদের দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।”

কিন্তু, কেন এত ক্ষোভ মানুষের? দীপকের মতোই মুখ খুললেন এলাকার অন্য তৃণমূল কর্মীরাও। উগরে দিলেন একের পর এক দুর্নীতির গল্প। জঙ্গলমহলের প্রায় সর্বত্র সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে নেতাদের লাখপতি হয়ে ওঠার কাহিনি। কিন্তু, সেই দুর্নীতিই কি একমাত্র কারণ এই ভরাডুবির?

জঙ্গলমহলের মানুষের কথাতেই পাওয়া গেল নতুন এক অসন্তোষের ইঙ্গিত। বাঁশপাহাড়ির এক তৃণমূল কর্মীর গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ল, “কোনও দলই আদিবাসীদের মানুষ বলে মনে করে না। নেতাইয়ে যাঁরা হার্মাদদের গুলিতে মারা গেলেন,তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিল সরকার। কিন্তু খাসজঙ্গলে যে তিনজন মারা গিয়েছেন তাঁদের কোনও ক্ষতিপূরণ সরকার দেয়নি। কারণ, খাস জঙ্গলের সবাই ছিলেন সাঁওতাল।” এই বিভেদের অভিযোগ যে আদিবাসী-মূলবাসী মানুষের মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে, তা স্পষ্ট বিনপুর-২ ব্লকের ফলে। সেখানে প্রায় ৩০জন নির্দল প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তাঁরা সবাই আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, মাওবাদী, বিজেপি, সিপিএম একজোট হয়েছে। যদিও তৃণমূলের একাধিক জেলা নেতৃত্ব বিজেপি-র এই জয়ের পিছনে গোষ্ঠীদ্বন্দকেই দায়ী করেছেন।

কেবল ঝাড়গ্রাম নয়, লাগোয়া বাঁকুড়ার রাইপুর, সারেঙ্গা, রানিবাঁধ— একাধিক ব্লকে জায়গা দখল করেছে বিজেপি। পুরুলিয়াতে তৃণমূলের ৮১৪টি আসনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজেপি-র আসন সংখ্যা ৬৮৮। সেখানেও ৫০টির বেশি পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের সম্ভাবনা বিজেপি-র।

আরও পড়ুন: সব নজির ভেঙে এ বার গণনা কেন্দ্রে ঢুকে অবাধ ছাপ্পা

সর্বত্রই একই দুর্নীতির অভিযোগ।সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে আদিবাসী সমাজের সঙ্গে মাহাতো সমাজের মধ্যে বেড়ে চলা দূরত্বও বিজেপি-র রাস্তা চওড়া করেছে বলে দাবি একাধিক তৃণমূল নেতার। পুরুলিয়ার এক তৃণমূল নেতার দাবি, “জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে মূল চালিকাশক্তি মাহাতোরা। দীর্ঘদিন জঙ্গলমহলে রাজনীতি করা মুকুল রায় সঠিক সময়ে মাহাতো সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাশার বীজটা পুঁতে দিয়েছেন। আর সেই চালেই কিস্তিমাত করেছে বিজেপি।” গত এক বছরে পুরুলিয়াতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক অশান্তি যে রাজনৈতিক মেরুকরণ করেছে, তার ফায়দাও বিজেপি ঘরে তুলেছে, মানছেন পুরুলিয়ার তৃণমূল নেতারা।

শাসকের গোষ্ঠীদ্বন্দ, দুর্নীতি বা আদিবাসী সমাজের অসন্তোষ— কারণ যাই হোক না কেন, জঙ্গলমহলের অন্দরের এই ফল শাসক দলের কাছে অশনিসঙ্কেত। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় জঙ্গলমহল হাসলেও, তার গভীরে যে শাসকের জন্য এত ব্যথা লুকিয়ে ছিল, তা প্রকাশ্যে এল এ দিনের এই ফলে। আর এটাই যদি ইঙ্গিত হয়, তবে লোকসভা নির্বাচনে এই আসন ধরে রাখা যে কঠিন হবে, তা আগেভাগেই স্বীকার করছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।

BJP TMC Jungle Mahal West Bengal Panchayat Election 2018
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy