গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সভাধিপতির পদ এ বার সংরক্ষিত তফসিলি জাতিভুক্ত মহিলাদের জন্য। তাই প্রার্থী তালিকায় ওজনদার তফসিলি মহিলা মুখ রেখেছেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। স্বরূপনগরের দু’বারের বিধায়ক বীণা মণ্ডলকে ১৩ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে। কিন্তু এক দিকে দলীয় কোন্দল, অন্য দিকে বসিরহাট দাঙ্গার ক্ষত— কঠিন লড়াইয়ের মুখে ‘সভাধিপতি প্রজেক্ট’। রবিবার রাত থেকেই তাই বোমাবাজি শুরু হয়েছে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতে। সোমবার সকাল থেকে গোলমাল ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাতেও।
রবিবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ বোমাবাজি শুরু হয় স্বরূপনগরের বিভিন্ন এলাকায়। প্রায় ভোর পর্যন্ত বোমার আওয়াজ শোনা গিয়েছে ব্লকের নানা প্রান্ত থেকে। চারঘাট, সগুনা-মোমিনপুর এবং তেপুল-মির্জাপুর অঞ্চলেই উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। এলাকাবাসীর বড় অংশের দাবি, যে আবহে সোমবার সকালে ভোট শুরু হয়েছে স্বরূপনগরে, আগে কখনও তেমনটা দেখা যায়নি উত্তর ২৪ পরগনার এই অংশে।
এক সময়ে স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতির দখল ছিল যে কংগ্রেসের হাতে, সেই কংগ্রেস এখন প্রান্তিক শক্তি সীমান্তবর্তী এই ব্লকে। তৃণমূলের মূল চ্যালেঞ্জার আপাতত বিজেপি এবং সিপিএম-ই। অধিকাংশ আসনেই শাসকের বিরুদ্ধে বিজেপি-সিপিএম দু’দলেরই প্রার্থীরা রয়েছেন। কিন্তু চোরাস্রোতের মতো সমঝোতাও হয়ে গিয়েছে বলে গুঞ্জন। কোথাও লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিজেপি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজেপি প্রার্থী বলে দিয়েছেন, সিপিএমকে ভোট দিতে। কোথাও নীরবে নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে সিপিএম। বিজেপির জয়ের পথ সুগম করতে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে স্বরূপনগর বিধানসভায় কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী ছিলেন স্কুলশিক্ষক ধীমান সরকার। প্রচারে ধীমানের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন যাঁরা, তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘আমাদের শাঁড়াপুল-নির্মাণ গ্রাম পঞ্চায়েতে সব বিরোধী কিন্তু এককাট্টা। আমরা বরাবর সিপিএম করে এসেছি। কিন্তু এ বার জানি, সিপিএম আমাদের এলাকায় জিততে পারবে না। তাই...।’’ কথা উহ্য রয়ে যায়।
আরও পড়ুন: লাইভ: শান্তিপুর-আমডাঙা-কুলতলি-দেগঙ্গায় খুন, ব্যালট লুঠ-বোমা-গুলির মধ্যেই চলছে ভোট
১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে স্বরূপনগর ব্লকে। ইছামতীর পূর্বে ৭টি, পশ্চিমে ৩টি। পশ্চিমের তিনটি পঞ্চায়েতেই লড়াই বেশি কঠিন। চারঘাট এবং সগুনা-মোমিনপুরে বেশ ব্যাকফুটে তৃণমূল। তেপুল-মির্জাপুরে কাঁটার টক্কর। আর ঘটনাচক্রে এই তিন পঞ্চায়েত নিয়ে যে জেলা পরিষদ আসন, সেই ১৩ নম্বরেই প্রার্থী সম্ভাব্য সভাধিপতি বীণা মণ্ডল। উত্তেজনা অতএব তুঙ্গে।
চারঘাটের এক সিপিএম কর্মী বললেন, ‘‘কাল রাতেই বাইক বাহিনী নিয়ে চারঘাটে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। সিপিএম-বিজেপি হাত মিলিয়ে আটকে দিয়েছে। বাইক বাহিনী বেরোতেই পারছিল না এলাকা থেকে। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করেছে।’’ পেশায় ওষুধ ব্যবসায়ী ওই সিপিএম কর্মীর কথায়, ‘‘চারঘাট, সগুনায় তৃণমূল কিচ্ছু করতে পারবে না। এখানে গন্ডগোল করলে, পাল্টা করার লোকও রয়েছে। কিন্তু তেপুলে পাল্টা মারার লোক নেই। তাই তেপুলটাই টার্গেট করেছে তৃণমূল।’’
মনোনয়ন পর্বেই শিরোনামে চলে এসেছিল বীণা মণ্ডলের আসন। সিপিএম প্রার্থীর বাড়ি গিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়ে গণপ্রহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন সিভিক ভলান্টিয়ার। সেই এলাকাই রবিবার রাত থেকে ফের উত্তপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।
সিপিএমের দাবি, মধ্যমগ্রাম-বারাসত থেকে দুষ্কৃতীদের আমদানি করা হয়েছে এলাকায়। গোবরডাঙা পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন লজে তাদের রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। রবিবার রাত থেকে তারা লাগোয়া স্বরূপনগরে ঢুকতে শুরু করে বলে খবর। শ’দেড়েক দুষ্কৃতীকে কাজে লাগিয়ে তেপুল-মির্জাপুরে অন্তত ১০টি বুথ দখল করে অবাধে ভোট লুঠ করার ছক কষেছে শাসক দল। বলছে বিরোধীরা। ‘‘ওই বুথগুলো দখলে নিতে না পারলে বীণা মণ্ডল কিছুতেই জিতবেন না,’’ দাবি তৃণমূল কর্মীদের।
বিধায়ক তথা জেলা পরিষদের প্রার্থী বীণা মণ্ডল অবশ্য প্রথমেই অভিযোগ নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘‘আমি তো সকাল থেকেই বুথে বুথে ঘুরছি। কোথাও কোনও গন্ডগোল নেই তো!’’ কিন্তু রবিবার রাত থেকেই তো বিভিন্ন এলাকায় গোলমাল-বোমাবাজির খবর আসছে। এ বার পুরোপুরি অস্বীকার করলেন না বিধায়ক। বললেন, ‘‘রাতে কিছুটা হয়েছিল। এখন সব শান্তিতেই হচ্ছে।’’
বিরোধীরা বলছেন, আপনাকে জেতানোর জন্য তেপুল-মির্জাপুরে ১০টা বুথ দখলের ছক কষা হয়েছে? সরাসরিই করতে হল এ বার প্রশ্নটা। বিরক্তি নিয়ে বিধায়ক বললেন, ‘‘ছাড়ুন তো! আমার বিরুদ্ধে যে কী চক্রান্ত চলছে, সে ভাবতে পারবেন না।’’
আরও পড়ুন: গুলি-বোমা-মার-খুনোখুনিতে রক্তাক্ত পঞ্চায়েত ভোট
বীণার অস্বস্তি কিন্তু শুধু বিরোধীদের নিয়ে নয়। অস্বস্তি নিজের দলকে নিয়েও।
স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে যাঁকে কিছুতেই বসতে দিতে চাননি বীণা মণ্ডল, সেই বীণার জেলা পরিষদ আসন সেই ঝুমা সাহারই এলাকায়। জেলা তৃণমূলের কার্যনির্বাহী সভাপতি তথা বিদায়ী জেলা পরিষদের পূর্ত ও পরিবহণ কর্মাধ্যক্ষ নারায়ণ গোস্বামীর অনুগামী হিসেবে পরিচিত ঝুমাই শেষ পর্যন্ত সভাপতি হন। এলাকায় তাঁর প্রভাবও বাড়ে। যা মোটেই স্বস্তির কথা নয় বীণা মণ্ডলের জন্য।
নারায়ণ গোস্বামী নিজে যখন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন, তখন তিনিও ওই এলাকা থেকেই জিতে এসেছিলেন। ফলে এলাকায় নারায়ণের প্রভাবও নেহাত কম নয়। আর স্বরূপনগরের রাজনীতিতে নারায়ণ আর বীণার সম্পর্ক কতটা ‘মধুর’, সে কথা কারও অজানা নয়। অস্বস্তি সেখানেও।
সেই কারণেই কি বীণা বললেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে যে কী চক্রান্ত চলছে, সে ভাবতে পারবেন না,’’— মুখ খুলতে চান না তৃণমূল কর্মীরা।
গোলমাল শুধু ইছামতীর পশ্চিমে অবশ্য সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া আমুদিয়ায় বাইক বাহিনীর দাপট দেখা গিয়েছে সোমবার সকাল থেকেই। আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকায়। আর এক সীমান্তবর্তী গ্রাম বিথারীতেও বুথে বুথে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা গোলমাল করছে বলে অভিযোগ। দত্তপাড়া গ্রামে সংঘর্ষ হয়েছে তৃণমূল সমর্থক এবং নির্দল প্রার্থীর অনুগামীদের মধ্যে। বেনজির পরিস্থিতির মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোটে সামিল হওয়ার চেষ্টা করছে সীমান্তবর্তী স্বরূপনগর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy