লোকসভা ভোটে প্রচার পর্ব থেকেই পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ এবং উদ্বাস্তু প্রসঙ্গ নিয়ে সরব হয়েছে বিজেপি। বর্ধমান-কাণ্ডের পরে অনুপ্রবেশ প্রশ্নে সুর আরও চড়া করেছে তারা। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল আবার পাল্টা চেষ্টা চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ত্রাতা হিসাবে নিজেদের তুলে ধরে মেরুকরণের রাজনীতির ফায়দা নেওয়ার। সেই লড়াইয়ে এ বার ঢুকল সিপিএম!
উদ্বাস্তু প্রসঙ্গকে শুক্রবার নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবিতে তাঁরা আন্দোলনের পথে যাবেন বলে ঘোষণা করেছেন তিনি। গৌতমবাবু জানিয়ছেন, প্রথমে ২৯ অক্টোবর কৃষক সংগঠনের হয়ে কর্মসূচি নেওয়া হবে এবং পরে ডিসেম্বরে হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে সঙ্গে নিয়ে নাগরিকত্বের দাবিতে জেলাশাসকের দফতর ঘেরাও করা হবে। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি-র কাছে যে ভাবে এ রাজ্যে জমি হারিয়ে ফেলছে সিপিএম, তার জেরেই কি গৌতমবাবুরা এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? একই কারণেই কি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বর্ধমান-কাণ্ডে এনআইএ তদন্তের পক্ষে সওয়াল করছেন? সচরাচর যে সুর সিপিএমের গলায় শোনা যায় না!
রাজারহাটে দলীয় কার্যালয়ে এ দিন গৌতমবাবু বলেছেন, “১৯৭১ সালের পরে যাঁরা এ দেশে শরণার্থী হিসাবে এসেছেন, বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়, তাঁদের নাগরিকত্বের মর্যাদা দিতে হবে।” উদাহরণ দিয়ে তাঁর আরও বক্তব্য, “কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত হয়ে যাঁরা দিল্লিতে এসেছেন, তাঁদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে। অথচ এখানে জাতীয় সড়ক, রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে উদ্বাস্তুরা ফাঁকা জমি দখল করে থাকেন। এই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবিতেই ২০ হাজার লোক নিয়ে ডিসেম্বরে বারাসত জেলাশাসকের অফিস ঘেরাও করব!”
কোনও কোনও মহলে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ থেকে রুটি-রুজির তাড়নায় যাঁরা এ পারে চলে এসেছেন, তাঁদের কেন শরণার্থী বলা হবে? এঁদেরই অনুপ্রবেশকারী বলে সরব হয়েছে বিজেপি এবং আরএসএস। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, সিপিএম-ও কি তা হলে তৃণমূল নেত্রীর পথ ধরে সংখ্যালঘু মন পেতে মরিয়া হয়ে উঠল? গৌতমবাবুদের বক্তব্য, এই ব্যাখ্যা আদপেই ঠিক নয়। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “বাংলাদেশ থেকে উৎপীড়নের শিকার হয়ে যাঁরা এ পারে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, অর্থাৎ যাঁরা ও’দেশে সংখ্যালঘু, আমরা তাঁদের কথাই বলছি। এই মর্মে আমাদের বিগত পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব পাশ হয়েছে। মনমোহন সিংহ বিরোধী দলনেতা থাকাকালীন রাজ্যসভায় এঁদের জন্যই নাগরিকত্বের দাবিতে সরব হয়েছিলেন।” সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা, তৃণমূল সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের মৃত্যুতে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন অনিবার্য। মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবি বহু দিনের। সেই অঙ্ক মাথায় রেখেই উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবি ফের সামনে এনেছেন গৌতমবাবু। বিশেষত, বনগাঁ এবং মতুয়া-মহলে বিজেপি-র সক্রিয়তা রুখতেই এই দাবি।
এক দিকে যেমন গৌতমবাবুরা উদ্বাস্তু-অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন, তেমনই আবার বর্ধমানের ঘটনায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন কারাটেরা। ঘটনার পরেই দলের পলিটব্যুরো যে বিবৃতি দিয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি করেই বৃহস্পতিবার কলকাতায় কারাট বলেছেন, “বর্ধমানের বিস্ফোরণ স্থানীয় ঘটনা নয়। রাজ্য এবং দেশের বাইরেও এর যোগ আছে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এনআইএ-র মতো উপযুক্ত কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত প্রয়োজন। এর মধ্যে রাজ্যের এক্তিয়ারে অনধিকার প্রবেশের প্রশ্ন আসছে না।” সিপিএমের মুখে জাতীয় নিরাপত্তার কথা খুব বেশি শোনা যায় না বলে সমালোচনা দীর্ঘ দিনের। চিন-রাশিয়া নিয়েই বরং তারা মাথা ঘামায় বেশি! এ ক্ষেত্রে কি তা হলে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের ফায়দা বিজেপি নিয়ে চলে যাবে ভেবেই উল্টো রাস্তায় হাঁটলেন কারাটেরা?
সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের অবশ্য ব্যাখা, “খাগড়াগড়ে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং তা থেকে যে রকম সন্ত্রাসবাদী-মৌলবাদী যোগসাজশের অভিযোগ এসেছে, তার তদন্ত করার মতো পরিকাঠামো রাজ্য পুলিশের নেই। তাই এনআইএ তদন্তের দাবি। এর মধ্যে তাত্ত্বিক অবস্থান বা স্ব-বিরোধিতার কোনও প্রশ্ন নেই! এমন তো নয়, আমরা অতীতে এনআইএ তদন্তের বিরোধিতা করে এখন পক্ষে বলছি! সেই দ্বিচারিতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন।” সিপিএম নেতারা আরও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ইউপিএ-১ আমলে সংসদে এনআইএ আইন পাশ হওয়ার সময়েই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপের প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হয়ে গিয়েছে। তখনই ঠিক হয়েছিল, এনআইএ তদন্ত করলে রাজ্য প্রশাসন তার সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কিন্তু বর্ধমানের ক্ষেত্রে মমতা প্রশাসন এনআইএ-র সঙ্গে অসহযোগিতার পথে গিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থার সাহায্য নিতে হচ্ছে বলে সিপিএমের দাবি।
এরই মধ্যে তৃণমূল নেত্রী অবশ্য এ দিনও বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ অব্যাহত রেখেছেন। তৃণমূল ভবনে দলের বৈঠকে নেতা-কর্মীদের যেমন সক্রিয় ভাবে বিজেপি-বিরোধিতায় নামতে বলেছেন, তেমনই বৈঠকের পরে মমতা নিজে বিজেপি-র প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছেন, “উগ্রপন্থীদের কোনও জাত হয় না। এটা অপরাধমূলক কাজ। কিন্তু পুরোপুরি একটা সম্প্রদায়কে এই অভিযোগে জড়ানো ঠিক নয়।”
যদিও বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বোঝাতে চেয়েছেন, “সব মুসলিম জঙ্গিবাদের সমর্থক নন। মাদ্রাসা মানেই জঙ্গি কাজের আখড়া, তা-ও আমরা মনে করি না। আমরা শুধু ভারত-বিরোধী মুসলিম এবং মাদ্রাসার বিরুদ্ধে।” পাশাপাশিই এ রাজ্যে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেছেন, পুরসভার সামনে দলীয় কর্মসূচিতে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক তথা রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, “একের পর এক তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে আরডিএক্স পাওয়া যাচ্ছে। আর মমতাজি বিজেপি-র কাছে জবাব চাইছেন? জবাব তো আপনাকে দিতে হবে!” তাঁদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করার অভিযোগ উড়িয়ে সিদ্ধার্থনাথের আরও বক্তব্য, “বিস্ফোরণ এবং বোমা উদ্ধার নিয়ে কথা বলা সাম্প্রদায়িকতার বিষয়? এটা রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রশ্ন।”
বামেরা আবার রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করার অভিযোগে বিঁধেছে তৃণমূল এবং বিজেপি, দু’দলকেই। সিপিএম নেতা গৌতমবাবু বলেছেন, “মুসলিম মানেই তো উগ্রপন্থী নয়! উগ্রপন্থী হিন্দুদের মধ্যেও আছে। গাঁধীজি, ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধীকে যারা খুন করেছিল, তারা কি মুসলিম?” দু’দিন আগে ঠিক একই কথা বলেছিলেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। আলিমুদ্দিনে এ দিনই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন, এসইউসি, পিডিএস-সহ বামফ্রন্টের বাইরের দল এবং বাম শরিক মিলে ১৭টি দলের বৈঠক ছিল। সেখানে ঠিক হয়েছে, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কনভেনশন হবে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “সব ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজ্যে ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।”