আগামী বিধানসভা ভোটকে সামনে রেখে হিন্দু ভোট এক জোট করার আহ্বান জানিয়ে বার বার ‘কট্টর হিন্দুত্বে’র বার্তা দিতে দেখা গিয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ রাজ্য বিজেপির অনেক নেতাকেই। বাংলাদেশ এবং এ-পারে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, মহেশতলার ঘটনার পরে প্রচারের এই সুর সপ্তমে উঠেছিল। কিন্তু দলের রাজ্য সভাপতি হয়েই শমীক ভট্টাচার্য তাঁর প্রথম ভাষণে বলেছেন, বিজেপি দেশ ও বাংলার সংখ্যালঘুদের ‘প্রকৃত উন্নয়নে’র জন্য সক্রিয়। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিজেপি কোনও ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করেনি। সূত্রের খবর, শমীকের এই সুরে সিলমোহর দেওয়া হয়েছে সাংগঠনিক বৈঠকেও।
দলীয় সূত্রের খবর, শমীক সভাপতি হওয়ার পরে শুক্রবার প্রথম সাংগঠনিক বৈঠকেই দলের কৌশল সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দীনেশ ত্রিবেদী সেখানে জানান, শমীকের বক্তব্যই বঙ্গ বিজেপির জন্য ঠিক কৌশল। শমীক তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন, দল যত ‘কট্টরপন্থী’ অবস্থান নেবে, রাজ্যে সংখ্যালঘুরা ততই এক জোট হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেবেন। পক্ষান্তরে, উন্নয়নের বার্তা দিলেও সংখ্যালঘুদের ভোট বিজেপির ঝুলিতে না-ও আসতে পারে। কিন্তু একচেটিয়া ভাবে সংখ্যালঘুদের ভোট তৃণমূলে যাওয়ার পথটা রুদ্ধ হতে পারে। সূত্রের দাবি, বৈঠকে উপস্থিত সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডের মতো বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা শমীকের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।
কোন পরিস্থিতিতে বিজেপিতে সংখ্যালঘু প্রশ্নে ভিন্ন সুর নিতে হচ্ছে, তা নিয়েও চর্চা রয়েছে। রাজনৈতিক শিবিরের মতে এর নেপথ্যে থাকতে পারে তিন কারণ। প্রথমত, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, মহেশতলার পরে প্রথম ভোট ছিল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গিয়েছে কালীগঞ্জের হিন্দু-প্রধান ১১০টি বুথ থেকে বিজেপি ‘লিড’ পেলেও, হিন্দু-মনে ‘একাধিপত্য’ দেখা যায়নি। এমনকি, ওই বুথগুলিতে তৃণমূলেরও যথেষ্ট ভোট প্রাপ্তি হয়েছে। উল্টো দিকে, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত ১৫৪টি বুথে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ৫০-এর নীচে এবং প্রায় এককাট্টা ভোট পেয়েছে তৃণমূলে। দ্বিতীয় স্থানে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। দ্বিতীয়ত, আগাগোড়া আরএসএস করে উঠে আসা শমীকের বক্তব্যে সঙ্ঘের অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। আরএসএস বরাবর বলে এসেছে, ভারতের মুসলমান ও হিন্দুদের পূর্বপুরুষের ‘ডিএনএ এক’। তাঁরা উভয়েই ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ। তৃতীয়ত, ব্যক্তি শমীক সাধারণ শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিনিধি। হিন্দি-বলয়ে বিজেপির প্রচারের যে সুর, তাতে মধ্যবিত্ত বাঙালি ‘উগ্রতা’ খুঁজে পান, এই চর্চা বাংলার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন রয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই শমীক তাঁর বক্তব্যে ‘বহুত্ববাদে’র বার্তা দিয়ে বলেছেন, “এক সঙ্গে, এক সময়, একই রাস্তা দিয়ে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের মিছিল ও মহরমের তাজিয়া বেরোবে। বাংলার এই সংস্কৃতি, বহুত্ববাদকে রক্ষা করতে হবে।” পাশাপাশি, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী নজরুল ইসলামের মতো আপামর বাঙালির প্রিয় সাহিত্যিকদের কথা জুড়ে দিয়ে শমীক বলেছেন, “সংখ্যালঘু ভাই-বোনেরা ঠিক করুন, তাঁরা নজরুলের কথা শুনবেন, না কি হুমায়ুন কবীরের (তৃণমূল বিধায়ক) বক্তব্যকে গ্রহণ করবেন!”
দলের নতুন রাজ্য সভাপতির প্রথম বক্তৃতা নিয়ে যে আলোড়ন, সেই প্রশ্নে বিজেপির সদ্য প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, “রাজ্য সভাপতি যেটা বলেছেন, সেটাই দলের অবস্থান। ‘সবার সঙ্গে সবার বিকাশ’, আমাদের এই অবস্থান বহু দিন ধরেই স্পষ্ট করা হয়েছে।” যদিও রাজ্য বিজেপির একাংশ এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, সভাপতি হিসেবে শমীকের প্রথম বক্তব্য নিয়ে দলীয় শৃঙ্খলা ও শিষ্টাচারের প্রশ্নেই কাটাছেঁড়া করবেন না অন্য নেতৃত্ব। ফলে এই বিষয়টির এখনই বাড়তি তাৎপর্য না-ও থাকতে পারে। সেই সঙ্গে, আগামী দিনে পর পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহেরা রাজ্যে আসবেন। তাঁরা হিন্দুত্ব ও সংখ্যালঘুর প্রশ্নে কী সুর নেন, সে দিকেও নজর থাকবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবির।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)