Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সংস্কৃতি বিপন্ন, বিজেপির মিছিলে স্পষ্ট বার্তা

চার দিনের ব্যবধানে দু’টি মিছিল। দু’টিতেই ‘বাংলার সংস্কৃতিরক্ষার’ ডাক। তবু ফারাকটা প্রকট হয়ে উঠল। শনিবার এ রাজ্যের তৃণমূলপন্থী বিশিষ্টজনদের ডাকে মিছিলে যাঁরা সামিল হন, তাঁদের বেশির ভাগই ‘কী মিছিল, কেন মিছিল’ শুনেই কার্যত ঢোঁক গিলে পিঠটান দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার বিজেপির সমর্থনে বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী মঞ্চের ডাকে যে মিছিল পথে নামল, তা কিন্তু প্রতিবাদের স্পষ্ট বার্তা দিতে দ্বিধা করল না।

পতাকা ছাড়াই বিজেপি-পন্থী বিশিষ্টজনেদের মিছিল কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। ছবি: সুদীপ আচার্য।

পতাকা ছাড়াই বিজেপি-পন্থী বিশিষ্টজনেদের মিছিল কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

চার দিনের ব্যবধানে দু’টি মিছিল। দু’টিতেই ‘বাংলার সংস্কৃতিরক্ষার’ ডাক। তবু ফারাকটা প্রকট হয়ে উঠল।

শনিবার এ রাজ্যের তৃণমূলপন্থী বিশিষ্টজনদের ডাকে মিছিলে যাঁরা সামিল হন, তাঁদের বেশির ভাগই ‘কী মিছিল, কেন মিছিল’ শুনেই কার্যত ঢোঁক গিলে পিঠটান দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার বিজেপির সমর্থনে বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী মঞ্চের ডাকে যে মিছিল পথে নামল, তা কিন্তু প্রতিবাদের স্পষ্ট বার্তা দিতে দ্বিধা করল না।

সংস্কৃতি কোথায় বিপন্ন? কাদের জন্য বিপন্ন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আঙুল উঠেছে রাজ্যের শাসক দল এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই। কেউ সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে চক্রান্তের গন্ধ পেয়ে ‘চোরেদের’ পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টার নিন্দা করেছেন। কেউ বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় ‘শ্যালক-সম্বোধন’ করে অপভাষাই হল সংস্কৃতির জন্য সব থেকে বড় বিপদ।

কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা অবধি ‘মৌনমিছিল’ শেষে একটি ম্যাটাডরের পিঠে সওয়ার হয়ে ছোট্ট পথসভায় সাংবাদিক এম জে আকবর বললেন, বাংলায় নতুন করে দানা-বাঁধা পরিবর্তনের আশার কথা। “৩৪ বছর ধরে এখানে লাল সেলাম চলেছে। এখন ‘সারদা সেলাম’ বা ‘স্ক্যাম সেলাম’ চলছে। বাংলার মানুষ প্রতারিত। তাই বিজেপির দিকে তারা তাকিয়ে আছে।” জাদুকর পিসি সরকারের ক্ষোভ, “পদে পদে কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। কে কী কাগজ পড়বে, বা পড়বে না, সেটাও এক জন মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করে দিচ্ছেন’! ইংরেজ শাসনও এর থেকে ভাল ছিল!” দুর্নীতিকে ‘ভ্যানিশ’ করে ‘ম্যাজিকের সরকার’ আনার ডাক দিয়েছেন জাদুকর।

বাংলায় নতুন করে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে মিছিলে এসেছিলেন টালিগঞ্জের অভিনেতা জয়জিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, নিমু ভৌমিক, জর্জ বেকার, সুমন চৌধুরী ও প্রাক্তন পুলিশকর্তা রঞ্জিত মোহান্তি। আর ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা বহু অরাজনৈতিক মুখ নানা দাবিতে এই মিছিলকেই হাতিয়ার করেছেন। যেমন কাঁকিনাড়ার সুজন দাস এবং জয়নগরের বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। তাঁরা একটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট। কোটি টাকার ধাক্কা খেয়ে প্রতিকারের দাবিতে দরজায় দরজায় ঘুরছেন। বিশ্বনাথ বললেন, “আগে বামপন্থীদের মিছিলে হেঁটেছি। দরকারে বিজেপির সঙ্গেও থাকব।”

এই মিছিলে কেন? অভিনেতা জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “চুরির অধিকারের দাবিতে মিছিলটায় সামিল হওয়া সম্ভব ছিল না। সারদা কেলেঙ্কারির প্রতিবাদে বামফ্রন্টের গণকনভেনশনে রাজনীতির ব্যানার ছিল। তাই বিজেপির ডাকা পতাকাহীন মিছিলটাই ঠিকঠাক মনে হল।”

চার দিন আগে শাসক দলের অনুগতদের মিছিল তাকিয়েছিল টালিগঞ্জের গ্ল্যামার-কোশেন্টের দিকে। পুরোভাগে ছিলেন টলিউডি তারকা (বর্তমানে তৃণমূল সাংসদ) দেব ও ফিল্ম-টিভির কয়েক জন চেনা, আধো-চেনা মুখ। আর এ দিনের মিছিলের সামনের ব্যানারটির পিছনে সংস্কৃতি-জগতের কয়েকটি পরিচিত মুখের সঙ্গে হেঁটেছেন বামনগাছিতে দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত প্রতিবাদী যুবক সৌরভের বাবা শরৎ চৌধুরীও। তিনি বলেন, “সৌরভের মতো ছেলেদের মৃত্যু একের পর এক ঘটেই চলেছে। পাড়ুইয়েও তো তরুণরা হিংসার বলি হল।”

শাসক দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে মিছিলের একেবারে সামনে ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থের স্ত্রী শর্মিষ্ঠা। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া শর্মিষ্ঠাদেবীর কথায়, “এ মিছিল, চোরদের বাঁচাতে নয়, ধরতে!” পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে তোপ দেগে তিনি বলেন, “মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্তে পুলিশও শরিক। সারদা-কাণ্ডেও পুলিশের সকলের ভূমিকা ঠিকঠাক নয়। সারদা-তদন্ত থেকে শুরু করে পাড়ুই, আলিপুর সর্বত্র পুলিশের ভূমিকা লজ্জার।” প্রাক্তন ফুটবলার ষষ্ঠী দুলেও ‘গরিব মানুষের টাকা ফেরতের দাবিতে’ পথে নামার কথা বলেছেন।

রাজ্যের শাসক দল অবশ্য ‘নামজাদারা কই’ বলে এই মিছিলটাই নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছেন। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মিছিলে যাঁরা হাঁটলেন, তাঁরা তো বেশির ভাগই বিজেপির নিজেদের লোক। ভোটে দাঁড়িয়ে হেরেও ছিলেন। বাংলার বিশিষ্টজনেরা বিজেপির বিভাজনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।” লোক জমায়েতের নিরিখে এ দিনের মিছিল এবং তৃণমূলপন্থীদের মিছিল দু’টোই তুল্যমূল্য ছিল বলে লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে। তবু তৃণমূলপন্থীদের মিছিলের আহ্বায়ক ইন্দ্রনীল সেন-অরিন্দম শীলেরা খানিকটা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে এ দিনের মিছিলটা আলোচনার যোগ্য নয় বলেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ইন্দ্রনীলের কথায়, “এ মিছিল তো ফ্লপ শো বললেও বেশি বলা হয়!” আর অরিন্দম বলেন, “যাঁরা হেঁটেছেন, তাঁরা তো বেশির ভাগই ফসিল হয়ে গিয়েছেন।”


মঙ্গলবার কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিজেপির মিছিলের ছবিটি তুলেছেন শুভাশিস ভট্টাচার্য।

মিছিলের অন্যতম আহ্বায়ক অভিনেতা সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্টা জবাব, “আমরা অন্তত কেন হাঁটছি, জেনেশুনে পথে নেমেছিলাম। এর আগের দিন যাঁরা পথে নামেন, তাঁদের মতো মিডিয়ার সামনে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে যাইনি।” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ তৃণমূলপন্থী বিশিষ্টজনদের মিছিলের দিনই সাংবাদিক বৈঠকে পাল্টা মিছিলের কথা বলেছিলেন। পরে রবিবার অমিত শাহের মঞ্চ থেকে ‘বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী মঞ্চ’ গড়ার কথা জানিয়ে মিছিলের কথা বলা হয়। এর বাইরে ফেসবুক এবং এসএমএসে বিক্ষিপ্ত বার্তাও পাঠানো হয়েছিল। সুমন এ দিন সকালেই ফেসবুকে লেখেন, “বাংলার সংস্কৃতি বাঁচানোর দাবিতে একটা অরাজনৈতিক পদযাত্রা হবে। যাঁরা এখনও মান ও হুঁশ নিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা অবশ্যই আসবেন।”

এর উল্টো পিঠে মুখ্যমন্ত্রী মমতা নিজে টলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা, নব্য তৃণমূল অরিন্দম শীল, গায়ক ইন্দ্রনীল সেন ও কবি সুবোধ সরকারকে শিল্পীদের পথে নামানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরে ফিল্ম-টিভির অভিনেতা-কলাকুশলীদের মিছিলে যোগ দেওয়াটা যে এক রকম বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল, তা অনেকেই ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিয়েছেন। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও তরুণ শিল্পীরা কাজে টিঁকে থাকার দায় থেকে নিরুপায় হয়েই মিছিলে যোগ দেন বলে মন্তব্য করেন।

তবু শাসক দলের নানা অপকীর্তির প্রতিবাদে এ দিনের মিছিলে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে চিত্রপরিচালক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, “কাজ না-পাওয়ার ভয়ে কত দিন গুটিয়ে বসে থাকব! স্রেফ তৃণমূলের বিরোধিতাই নয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পথে নেমেছি।” শ্রীকান্ত মোহতাদের প্রযোজিত কয়েকটি হিট ছবির পরিচালক কৌশিক। জনৈক অভিনেত্রী সঙ্গীতা সোনালী বলেন, “সারদা-কেলেঙ্কারির জেরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও ভুক্তভোগী। তা রাজ্য বিজেপির কয়েকটি সেলের সদস্যরা, বিজেপির সহমর্মী কয়েকটি সংগঠনের কিছু লোকজনও মিছিলে হাঁটেন। কলকাতায় দু’-দু’টি রাজনৈতিক দলের ডাকে বিশিষ্টজনদের পরপর দু’টি মিছিল দেখে কৌতুকের সুর কংগ্রেসের পোড়খাওয়া নেতা মানস ভুঁইয়ার গলায়। বললেন, “রাজনৈতিক ছাতার নীচে ‘বুদ্ধিজীবীদের’ মিছিল সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্কটে ফেলে দিচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE