Advertisement
০২ মে ২০২৪
Mamata Banerjee

মোদীর সভার জখমদের দরজায় তৃণমূল, পাল্টা সভায় দলবদলের ইঙ্গিত

বিজেপি-র মুখ পোড়াতে বা সে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অস্বস্তি বাড়াতে আগে যে পথ নিয়েছিল তৃণমূল, এ বারও সেই পথ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।

মেদিনীপুরে মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল চিত্র

মেদিনীপুরে মুখ্যমন্ত্রী। ফাইল চিত্র

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৮ ১৭:২৯
Share: Save:

প্রথমে মুখ পুড়েছিল ভাত খেয়ে। তার পরের বার জনসংযোগে গিয়ে। এ বার ফের একই অস্বস্তি ফিরতে চলেছে গেরুয়া শিবিরে। তবে আগের দু’বার অস্বস্তিতে পড়েছিলেন অমিত শাহ। এ বার তা ঘটতে পারে খোদ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে।

১৬ জুলাই মেদিনীপুর শহরে জনসভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোদীর ভাষণ শুরু হওয়ার সামান্য পড়েই দর্শকাসনের একটি ছাউনি ভেঙে পড়ে। অন্তত ৯০ জন জখম হন সে দুর্ঘটনায়। মোদীর জনসভায় গিয়ে যাঁরা জখম হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন বলে খবর। যে কলেজ গ্রাউন্ডে সভা করেছিলেন মোদী, সেখানেই ২৮ জুলাই পাল্টা সভা করতে চলেছে তৃণমূল। সেই জনসভায় গিয়েই তৃণমূলে যোগ দেবেন মোদীর সভায় জখম হওয়া বিজেপি সমর্থকরা। শোনা যাচ্ছে তেমনই।

বিজেপি-র মুখ পোড়াতে বা সে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অস্বস্তি বাড়াতে আগে যে পথ নিয়েছিল তৃণমূল, এ বারও সেই পথ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। ২০১৭ সালে নকশালবাড়ি গিয়ে যে পরিবারের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছিলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে সে পরিবারকে তৃণমূলে সামিল করিয়েছিলেন গৌতম দেব। চলতি বছরে পুরুলিয়ার লাগদা গ্রামে যাঁদের বাড়ি গিয়ে ‘জনসম্পর্ক’ করেছিলেন অমিত শাহ, রাত পোহাতে না পোহাতেই তাঁদের কলকাতায় আনা হয়েছিল। কালীঘাটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে তাঁদের হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল। এ বার ‘টার্গেট’ জখমরা। মেদিনীপুরে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় ছাউনি ভেঙে পড়ে যাঁরা জখম হয়েছিলেন, তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ইতিমধ্যেই তাঁদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে গিয়েছেন। ২৮ জুলাই মেদিনীপুর কলেজ গ্রাউন্ডে তৃণমূলের যে সভা হবে, সেখানে তাঁদের উপস্থিত হতে বলা হয়েছে।

১৬ জুলাই নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় যাঁরা জখম হয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের চিকিৎসাই মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হয়েছিল। বিজেপি-র তরফ থেকে কয়েক জনকে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল বলে রাজ্য বিজেপি জানায়। তাঁর চিকিৎসায় দল সব রকম সাহায্য করছে বলেও বিজেপি-র তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়।

গোয়ালতোড়ের দুলাল মাহাত অবশ্য অন্য কথা বলছেন। দুলালের স্ত্রী স্বর্ণ মাহাতও কলকাতাতেই চিকিৎসাধীন। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বললেন, ‘‘সে দিনের দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রীর পাঁজরের হাড় ভেঙেছিল। আর জি কর হাসপাতালে অপারেশন হয়েছে। প্রথম দিকে বিজেপি নেতারা পাশে ছিলেন। কিন্তু এখন আর কারও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।’’ দুলাল জানালেন, চিকিৎসা মূলত সরকারি খরচেই হচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে যে সব ওষুধ কিনতে হচ্ছে, তার জন্য খরচ হচ্ছে। কলকাতায় একটানা থাকতেও অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর অনুযোগ। বিজেপি-র তরফ থেকে কোনও একজন কয়েক দিন আগে হাসপাতালে এসে দেখা করেছিলেন বলে তাঁর দাবি। কিন্তু মঙ্গলবার থেকে ফের কারও দেখা মিলছে না, বার বার ফোন করা সত্ত্বেও বিজেপির কেউ হাসপাতালে আসছেন না। দাবি দুলাল মাহাতোর।

বিজেপি-র উপরে ক্ষোভ যে রয়েছে, তা দুলালের কথায় স্পষ্ট। কিন্তু সেই ক্ষোভ থেকে কি দলবদলের কথা ভাবছেন? ২৮ জুলাইয়ের সভায় গিয়ে কি জোড়াফুলের পতাকা হাতে তুলে নেবেন? দুলাল মাহাত জানালেন, ওই সভায় যেতে পারবেন কি না, এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তবে ওই সভায় তাঁকে যেতে বলা হয়েছে। কে বলেছেন যেতে? দুলাল বললেন, ‘‘গোয়ালতোড়ের নেতারাই বলেছেন। আমি তো কলকাতায় আছি। আমার সঙ্গে ওঁদের কথা হয়নি। কিন্তু তৃণমূলের নেতারা আমার বাড়ি গিয়েছিলেন। ২৮ জুলাই মেদিনীপুরে যেতে বলেছেন।’’ তৃণমূলের ডাকে কি সাড়া দিচ্ছেন? দুলাল মাহাত বললেন, ‘‘এখানে (কলকাতায়) থাকতে হলে আর কী ভাবে যাব? যদি তার আগে ফিরে যেতে পারি, তা হলে সভায় যাওয়া যেতেই পারে।’’

শুধু দুলাল মাহাতর বাড়িতে নয়, চিকিৎসার পরে যাঁরা ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন, পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা তাঁদের দরজাতেও পৌঁছে গিয়েছেন ইতিমধ্যেই। দুলালই জানালেন সে কথা। বললেন, ‘‘যাঁরা সুস্থ-সবল হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন, তাঁদের কাছেও গিয়েছিল শুনলাম। অনেকেই বোধ হয় যাবেন ২৮ তারিখ।’’

কলেজ গ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রীর সভায় ভেঙে পড়া ছাউনি। ফাইল চিত্র।

২৮ জুলাই মেদিনীপুর কলেজ গ্রাউন্ডে যে পাল্টা সমাবেশ হবে, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ঘোষণা করেছিলেন একুশের সমাবেশ মঞ্চ থেকে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী, ফিরহাদ হাকিম-সহ কে কে সে সভায় থাকবেন, তাও মমতাই ঘোষণা করে দেন সে দিন। তার পর থেকে জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল। মোদীর সভায় যেমন ভিড় হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি জমায়েতের লক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যেই যদি তৃণমূলে সামিল করানো যায় মোদী সভায় জখম হওয়া বিজেপি সমর্থকদের পরিবারগুলিকে, তা হলে বিজেপির জন্য ধাক্কাটা আরও জোরদার হবে— বলছেন জেলার তৃণমূল কর্মীরা।

তৃণমূলের জেলা সভাপতি অজিত মাইতি অবশ্য বিষয়টি নিয়ে প্রথমে সরাসরি মন্তব্য করতে চাইলেন না। মোদীর সভাস্থলের দুর্ঘটনায় যাঁরা জখম হয়েছিলেন, তাঁদের কি এ বার তৃণমূলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে? অজিত মাইতি বললেন, ‘‘আমার কিছু জানা নেই।’’ কিন্তু জখম বিজেপি সমর্থকদের অনেকের বাড়িতেই তৃণমূল কর্মীরা পৌঁছে গিয়েছেন বলে খবর আছে, ২৮ তারিখের সভায় হাজির হতে পারেন বলে জখমদের পরিজনরা জানাচ্ছেও। এ কথা শুনে অজিত মাইতি বললেন, ‘‘দেখুন, সে দিন যাঁরা জখম হয়েছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁদের একটা টান তৈরি হয়েছে। যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী নিজে হাসপাতালে গিয়ে তাঁদের দেখে এসেছেন এবং যত দ্রুত তাঁদের হাতে রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিয়েছে, সেটা তাঁরা ভাবতেই পারেননি। সেই কারণেই তাঁরা তৃণমূলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। সেই টান বা দুর্বলতা থেকে অনেকে ২৮ তারিখের সভায় হাজির হতেই পারেন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’’

আরও পড়ুন: কংগ্রেস ভাঙছি না, বিজেপিকে ঠেকাচ্ছি

বিজেপি অবশ্য যাবতীয় জল্পনা উড়িয়ে দিতে চাইছে। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বৃহস্পতিবার জানালেন, জখমদের কেউ আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন কি না, তিনি নিশ্চিত নন। আগে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তার পরে বললেন, ‘‘তৃণমূল ২৮ তারিখের সভায় হয়তো কাউকে কাউকে দেখিয়ে বলবে যে, এঁরা নরেন্দ্র মোদীর সভায় গিয়ে জখম হয়েছিলেন। কিন্তু যদি তেমন কাউকে দেখানোও হয়, তা হলে চোখ বন্ধ করে সে কথায় বিশ্বাস করবেন না। কারণ কোনও প্রমাণ নেই। সাজানো লোকজন দিয়েও ওই রকম করতে পারে তৃণমূল। কেউ তো আর প্রমাণ চাইতে যাচ্ছে না যে, যাঁদের দেখানো হচ্ছে, তাঁরাই জখম হয়েছিলেন কি না?’’ তার পরে সায়ন্তন বললেন, ‘‘কয়েকটা লোককে বেছে বেছে তুলে নিয়ে গিয়ে কিছু প্রমাণও করা যায় না। নরেন্দ্র মোদীর সভায় ছ’লক্ষ লোক হয়েছিল। তৃণমূল ওই জমায়েত করতে পারবে তো?’’

আরও পড়ুন: রাজ্যের নাম ‘বাংলা’, সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ বিধানসভায়

ছ’লক্ষ লোকের জমায়েতের কথা শুনে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতি অবশ্য হাসলেন। বললেন, ‘‘আমরা বিজেপির মতো গালগল্প করি না। আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন করে উঠে এসেছি তো। বিজেপির মতো ফাটকা রাজনীতি কখনও করিনি। অপেক্ষা করুন। ২৮ তারিখ জমায়েতের চেহারা দেখলেই সব জবাব পেয়ে যাবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE