ভয়াবহ দুর্যোগের পরে ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে আক্রান্ত বিজেপির জনপ্রতিনিধিরা। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎ প্রকাশ নড্ডাদের তৎপরতা। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মত, উৎসবের মরসুম শেষ হলেই বিজেপি যে ভাবে ঘাঁটি গেড়ে বঙ্গ অভিযানের পরিকল্পনা করেছে, তার আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই ‘বেনজির সক্রিয়তা’।
বিপর্যস্ত নাগরাকাটায় ত্রাণ বিলি করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। এই ঘটনার পরে কার্যত নজিরবিহীন ভাবে কড়া রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আক্রান্ত জনপ্রতিনিধিদের নিজের দলীয় সতীর্থ হিসেবে উল্লেখ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি। রাজ্যে সমাবেশ করতে এসে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ এর আগেও করেছেন মোদী। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে এমন প্রতিক্রিয়া সচরাচর দেখা যায় না। এর মধ্যে তাই বিশেষ ইঙ্গিত দেখছেন বিজেপি নেতৃত্ব। কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথও ফোন করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নড্ডা ফোনে কথা বলেছেন খগেন ও শঙ্করের সঙ্গে। এর পরেও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু এবং ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সাংসদ বিপ্লব দেবকে রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। দিল্লিতে বঙ্গ ভবনের সামনেও বিক্ষোভ করেছে বিজেপি। রাজ্যে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে চলেছে, তারই আগাম বার্তা এই ঘটনাপ্রবাহে ধরা পড়ছে বলে বিজেপি শিবির সূত্রে ইঙ্গিত।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তৃণমূল বড় ব্যবধানে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে বলে দাবি করছেন শাসক দলেরই বিভিন্ন স্তরের নেতারা। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের বক্তব্য, জুতসই বিরোধিতা না থাকায় বিধানসভা ভোটে জয়ের কাজটা তৃণমূলের সহজ হতে পারে। উল্টো দিক থেকে, তৃণমূলের সেই সাজানো রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি।
সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে সেনাপতি হিসেবে মাথার উপরে রেখে অন্তত ১২০০ নেতা ঘাঁটি গাড়তে পারেন বঙ্গে। তাঁদের পরিকল্পনাতেই নির্বাচনী যুদ্ধে ঘুঁটি সাজাবে পদ্ম শিবির। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই হয়তো রাজ্যে আনাগোনা শুরু হবে সেই নেতাদের। দেশের বহু বিজেপি সাংসদেরই বাংলামুখী হওয়ার কথা। তার আগেই দলীয় জনপ্রতিনিধিদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় পরিকল্পনার সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেল বলেই মনে করছে গেরুয়া শিবির। আগামী নির্বাচন পর্যন্ত শাসক তৃণমূলের উপরে এ ভাবেই চাপ তৈরির কৌশল নিতে পারেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। তার ফলে একই সঙ্গে নিচু তলার কর্মীদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ানো যাবে।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক অবশ্য বলছেন, ‘‘এক জন আদিবাসী সাংসদের রক্ত দিয়ে তৃণমূল কর্মীরা উত্তরবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বরণ করলেন! আদিবাসী গ্রামের ৯ জন ভেসে গিয়েছেন। এক জন আদিবাসী সাংসদ সেখানে ত্রাণ নিয়ে গেলেন। তাঁর উপরে প্রাণঘাতী হামলা হল। এই ঘটনা গোটা দেশে নজিরবিহীন। তাই প্রধানমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তৃণমূল বনাম সাধারণ মানুষের যুদ্ধ হবে। আমরা নিমিত্ত মাত্র!’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘তৃণমূল সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানুষও তৃণমূলকে উপড়ে ফেলে দিতে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছেন। আতঙ্ক থেকে তৃণমূল আক্রমণ করছে। বাংলায় যে কী রাজত্ব তৃণমূল কায়েম করে রেখেছে, এখন সকলে বুঝতে পারছেন।’’
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা দাবি, ‘‘বিজেপির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, মানুষের জন্য ভাবনাও নেই। নির্বাচনের আগে দুর্গত মানুষকে সামনে রেখে একটা অশান্তির পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। মানুষের কথা ভাবলে, ১০০ দিনের কাজ, আবাস ইত্যাদির জন্য তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য কি আটকে রাখত? সেই কারণেই তো ওদের প্রতি মানুষের এই প্রত্যাখ্যান, ক্ষোভ।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)