কানপাশা থেকে দু’গাছা চুড়ি, মায় বিয়ের আংটিটাও সংসারের চুলো জ্বালতে খুলে দিয়েছিলেন কোহিনুর বিবি। অনেক কষ্টে তুলে রেখেছিলেন বাবার দেওয়া ভরিখানেকের সোনার হারটা। কিন্তু সেটাও আর থাকল না।
স্বামীর বায়না, এই সুযোগ আর আসবে না। ৫৫ হাজার টাকা ভরি দরে সোনা বিক্রি হচ্ছে। তা-ও আবার কড়কড়ে নগদ টাকায়। শর্ত একটাই, নিতে হবে পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট। ক্ষতি কী? ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট তো ফাঁকাই পড়ে আছে। লাখখানেক টাকা ঢেলে দিলেই হল।
মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা ডোমকলে বাড়ি কোহিনুরের। তাঁর চেনাজানা অনেকেই এখন খুলে দিচ্ছেন দুল, চুড়ি, হার। নোট বাতিল হওয়া ইস্তক সোনার দোকানগুলো যখন মাছি তাড়াচ্ছে, বিয়ের মরসুমেও বিক্রিবাটা তলানিতে, গাঁ-গঞ্জে রমরম করে চলছে ঘরোয়া সোনার কারবার। নিখাদ কালো টাকায়। খোলা বাজারে এখন সোনার ভরি হাজার তিরিশেক টাকা, পুরনো নোটে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার দ্বিগুণ। কে না লোভের ফাঁদে পা দেবে?
কারা কিনছেন সোনা?
বাতাসে কান পাতলে যে সব নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের কেউ মহাজন (সুদের কারবারি), কেউ বা পাচার আর অন্য নানা অবৈধ ধান্দায় মোটা টাকা করেছেন। তার একটা বড় অংশ ব্যাঙ্কে জমা করতে না পেরে বাঁকা পথ ধরেছেন তাঁরা। সোনা কিনে কালোকে সাদা করছেন। কালো টাকায় যাতে সোনা কেনা না যায়, সে জন্য গয়নার দোকানেও নজরদারি করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকার। কিন্তু গেরস্থের সোনা বিক্রির হিসেব রাখবে কে?
রানিনগর গঞ্জে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী দীন মহম্মদ বলেন, ‘‘সরকার ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিল করার পরে আমাদের ব্যবসায় চরম মন্দা নেমে এসেছে। কিন্তু গেরস্থদের থেকে যে চড়া দামে পুরনো টাকায় সোনা কেনা হচ্ছে তার প্রমাণ পেলাম যখন চেনা কয়েক জন সুদের কারবারি আর এক বড় ব্যবসায়ী বেশ কয়েক ভরি সোনার গয়না এনে যাচাই করে দিতে বললেন, সেগুলো আসল কি না!’’
এলাকায় ঘুরে নামও পাওয়া গেল এ রকম কয়েক জনের। তবে কেউই স্বীকার করলেন না পুরনো নোটে সোনা কেনার কথা। না করারই কথা! কে আর নিজ মুখে চুরির কথা কবুল করে? তবে, নাম জানাজানি হলেও এই সোনার ধান্দা প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব। সাগরপাড়ার ফতিমা বেওয়া জানান, বড়লোক কারবারিরা নিজেরা আসছেন না। বাজারে নামছে তাঁদের ভাড়াটে লোকেরা। তাদের হাতে সোনা দিলে বাড়িতে নগদ টাকা দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এমন সুযোগ আর আসবে কি না, কে জানে? তাই হাতছাড়া করিনি।’’
প্রায় দ্বিগুণ দামে সোনা কিনে কী লাভ কালো টাকার কারবারিদের? ডোমকলের শাঁখা ব্যবসায়ী দেবদুলাল পালের ব্যাখ্যা, সময়ের সঙ্গে সোনার দাম তো বাড়বেই। নজরদারিও কমে যাবে। তখন সোনা বিক্রি করে ওঁরা পুষিয়ে নেবেন। একই কারণে অনেকে জমি কিনছেন। গাঁয়ে-গঞ্জে একলাখি জমির দাম চড়েছে দেড় লাখে। যদিও রেজিস্ট্রির সময়ে অনেক কম দর দেখানো হচ্ছে। চড়া দরে বিক্রি হচ্ছে কাঠ, এমনকী গোটা গাছও। জলঙ্গির কাঠ ব্যবসায়ী কামাল হোসেন মুচকি হাসেন, ‘‘নোট বাতিল হওয়ার পর থেকেই কাঠের তেমন চাহিদা ছিল না। ক’দিন আগে থেকে দাম চড়তে শুরু করেছে। ১০ হাজার টাকার কাঠ এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজারে। গোটা কয়েক গাছ ছিল, তারও ভাল দাম পেয়েছি।’’
ইসলামপুরের আসলাম আনসারি সব দেখে-শুনে খুব মজা পেয়েছেন। এর আগে কখনও চাষে লোকসান খেয়ে, কখনও অসুখ-বিসুখের ধাক্কায় মহাজনের কাছে বৌয়ের গয়না বন্ধক রেখে ধার নিতে হয়েছে তাঁকে। গয়না বিক্রিও করতে হয়েছে। একগাল হেসে তিনি বলেন, ‘‘সুযোগ পেয়ে ওরা কম দাম দিত বা সোনায় খাদ আছে বলে ঠকাত। চাকা উল্টে গিয়েছে। ওরাই এখন আমাদের হাতে-পায়ে ধরছে বেশি দামে সোনা বিক্রির জন্য।’’
তবে পুলিশের দাবি, তাদের কাছে এমন কোনও খবর নেই। নির্দিষ্ট খবর পেলেই দোষীদের ধরা হবে।
চাকা যে উল্টো ঘুরছে, সেই খবর কে আর কর্তাদের দিতে যাবে?
(সব নাম পরিবর্তিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy