এনুমারেশন ফর্ম ছেপে আসছে না। অথচ বুথ লেভেল অফিসারের (বিএলও) কাছে নাগাড়ে আসছে ভোটারদের ফোন। কেন ফর্ম ছেপে আসেনি, দিতে হচ্ছে সেই কৈফিয়ত। উত্তর পছন্দ না হলে মিলছে ভোটারদের একাংশের তরফে খারাপ ব্যবহার, এমনকি অকথ্য গালিগালাজও। সঙ্গে সামলাতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির থেকে আসা চাপ। আবার কোনও ভুলভ্রান্তির দায় যে তাঁদেরই, বিএলও-দের তা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে কমিশনও।
অসুস্থতার কারণে বিএলও-মৃত্যু ঘিরে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি পাশে সরিয়ে রাখলেও, স্বল্প সময়ে এই বিপুল কাজ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিএলও-দের বেশিরভাগকেই। সঙ্গে রয়েছে বয়স এবং অসুস্থতার ভার। প্রশ্ন উঠছে, বিএলও-নিয়োগ কি ভেবেচিন্তে করা যেত না! না কি দেওয়া জরুরি ছিল আরও কিছুটা সময়!
জেলা প্রশাসনের থেকে ছেপে আসা ফর্ম গ্রহণ, ভোটার তালিকা অনুয়ায়ী তা সাজানো, এক একজনের বাড়িতে গিয়ে ফর্ম দেওয়া, ফর্ম নিয়ে ভোটারের প্রশ্ন-কৌতূহল সামলানো, ফর্ম পূরণ করতে ভোটারকে সাহায্য করা, ভর্তি করা ফর্ম গ্রহণ করা, তা ডিজিটাইজ় করে কমিশনের নির্দিষ্ট অ্যাপে আপলোড করা—সবই একমাসের মধ্যে করে ফেলতে হবে বিএলও-দের। একেকটি ভোটকেন্দ্রে সর্বাধিক ১৫০০ জন ভোটার থাকেন। পরিবারপিছু পাঁচজন ধরলেও বাড়ির সংখ্যা অন্তত ৩০০টি। কমিশনের নির্দেশ, একেকটি বাড়িতে তিনবার করে যেতে হবে বিএলও-দের, অর্থাৎ যাতায়াত কমপক্ষে ৯০০ বার! এক বিএলও-র কথায়, ‘‘একদিকে ভোটার, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সকলের উপরে কমিশন। এ যেন যাঁতাকলে পেষার মতো পরিস্থিতি! আমরা যে কেউ, যে কোনও মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি।’’
কমিশনের বক্তব্য, ‘‘৭.৬৬ কোটি ভোটারের হিসাবে একেকটি এলাকার বাড়িগুলিকে বিএলও-পিছু ভাগের পরিকল্পনা হয়েছিল জেলা প্রশাসনগুলির সঙ্গে আলোচনা করেই।’’ তাদের সংযোজন, ‘‘শিক্ষক ছাড়াও একাধিক স্থায়ী সরকারি পদের তালিকা ছিল জেলা প্রশাসনগুলির কাছে। শারীরিক ভাবে যাঁরা অসমর্থ বা দুর্বল, তাঁদের নাম প্রত্যাহারের সুযোগও ছিল জেলা প্রশাসনের কাছে চিকিৎসকের শংসাপত্র-সহ আবেদন করে। প্রতি ১০জন বিএলও-পিছু একজন করে সুপারভাইজার রয়েছেন। তাঁদের উপর রয়েছেন ইআরও। তাঁদের কাছে সমস্যা জানানোর সুযোগ রয়েছে।’’ কিন্তু নিয়ম থাকলেও সেই প্রক্রিয়া যথাযথ মানা হয়েছে কি না, পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে সে নিয়েও। সোমবার কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ছ’কোটি ফর্ম বিলি হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি জটিলতা দেখা দিয়েছে অনলাইন ফর্ম পূরণ নিয়ে। প্রধানত, যার সুবিধা নেওয়ার কথা অন্য রাজ্য বা বিদেশে থাকা নাগরিক-সহ পরিযায়ী শ্রমিকদের। সেখানে ভোটার কার্ডের সঙ্গে ফোন নম্বর যুক্ত করতে হচ্ছে আগে। তবে অনলাইনে দেওয়া ফর্ম-৮ ভরে (শুধুমাত্র ফোন সংশোধন সংক্রান্ত বিভাগ) তা করা গেলেও, অনেকে আটকে যাচ্ছেন তার পরের ধাপে। কারণ, সেখানে আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডে থাকা নামের বানান একই হতে হবে। না হলে ফর্ম জমা করা যাবে না। অথচ প্রযুক্তির কারণে অনেকেরই নামের বানান দুই কার্ডে ভিন্ন থাকে। প্রসঙ্গত, এসআইআর-মামলার সময়ে শুরুতে আধারকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে মানতেই চায়নি কমিশন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা তালিকাভুক্ত হয়। ফলে প্রশ্ন উঠছে, অনলাইন এখন আধার নির্ভর করা নিয়ে এত জোর দেওয়া হচ্ছে কেন!
যদিও কমিশনের বক্তব্য—অনলাইনে যে কেউ ফর্ম ভরতে পারেন। ভোটারের হয়ে অন্য কেউ তা করলেও অসুবিধা নেই। আধার সচিত্র পরিচয়পত্র হিসাবে স্বীকৃত। যোগ্য ভোটার যাচাইয়ের জন্য তার মাধ্যমে ই-সাইন সম্ভব। সে কারণেই এই পদক্ষেপ। তা কেউ করতে না পারলে নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে বিএলও মারফত ফর্ম জমা দেওয়া সম্ভব। কর্মসূত্রে বিদেশে থাকা কোনও ব্যক্তির আত্মীয় নির্দিষ্ট ঠিকানায় না থাকলে ফর্ম জমা হবে না। তাতে খসড়া তালিকাতেও তাঁর নাম থাকবে না। কমিশনের এক কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘৯ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পর থেকেই আবেদন-অভিযোগ জানানো যাবে কমিশনে। তখন তেমন কেউ অনলাইনে ‘ফর্ম-৬’ পূরণ করলেই তাঁর নাম থাকবে ভোটার তালিকায়।
আবার সাধারণ ফর্ম ভরার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলির ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য মানুষের চিন্তা বাড়াচ্ছে। অবশ্য কমিশনের বক্তব্য—ফর্ম নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নিবিড় প্রচার হচ্ছে। বিএলও ছাড়াও সহযোগিতার জন্য রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। তা ছাড়া কমিশনের একাধিক হেল্পলাইন রয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)