E-Paper

বিজেপির হিন্দু আধিপত্যের তত্ত্ব মিলছে না বুথ-চিত্রে

বাংলায় ভোট মানেই বুথে বুথে যে ‘ভূতের দাপট’ সাম্প্রতিক কালে বহু জায়গায় বহু বার ধরা পড়েছে, নদিয়ার কালীগঞ্জ সেই তালিকায় ব্যতিক্রম। এই বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতি বুথে বিরোধীদের অস্তিত্ব ভাল ভাবেই দৃশ্যমান।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ০৯:২১
বিজেপির প্রচার ছিল চড়া হিন্দুত্বের তারে বাঁধা।

বিজেপির প্রচার ছিল চড়া হিন্দুত্বের তারে বাঁধা। —প্রতীকী চিত্র।

একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। রাজ্য রাজনীতির ক্ষমতার ভারসাম্যে কোনও পরিবর্তনের সুযোগ সেখানে ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে স্বল্প গুরুত্বের এই উপনির্বাচনের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে উঠে আসছে তাৎপর্যপূর্ণ দু’টি ছবি।

প্রথমত, বাংলায় ভোট মানেই বুথে বুথে যে ‘ভূতের দাপট’ সাম্প্রতিক কালে বহু জায়গায় বহু বার ধরা পড়েছে, নদিয়ার কালীগঞ্জ সেই তালিকায় ব্যতিক্রম। এই বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতি বুথে বিরোধীদের অস্তিত্ব ভাল ভাবেই দৃশ্যমান। এক একটি বুথে শাসক দলের বাক্সে কার্যত সব ভোট এবং বিরোধীদের খাতায় শূন্য বা নামমাত্র ভোট পড়ার ‘চেনা’ ছবি এই উপনির্বাচনে অন্তত নেই। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কোথাও বিরোধী বিজেপির লড়াই, আবার কোথাও কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভোট ‘লুটে’র অভিযোগ এ বারের উপনির্বাচনে বিরোধীরা তোলেনি, বড় কোনও অশান্তির ঘটনাও ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনের নজরদারির বেশ কিছু পদক্ষেপকে এর জন্য কৃতিত্ব দিচ্ছে বিরোধী শিবির।

দ্বিতীয়ত, কালীগঞ্জের ৩০৯টি বুথের ভোট-চিত্র বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসছে, সংখ্যালঘু বা মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় যেমন একচ্ছত্র দাপট দেখাতে পেরেছে তৃণমূল, হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় তার উল্টোটা বিজেপির পক্ষে হয়নি। হিন্দু ভোট ভাগ হয়েছে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে। হিন্দু-প্রধান অনেক বুথেই জয়-পরাজয়ের মধ্যে ব্যবধান সামান্য। কালীগঞ্জের ফল ঘোষণার পরে হিন্দু সমর্থনে একাধিপত্যের যে দাবি বিজেপির অমিত মালবীয়েরা করেছেন, বুথের তথ্য সে কথা বলছে না।

প্রসঙ্গত, কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে কালীগঞ্জে গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন ও এই ২০২৫-এর উপনির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ-হার ক্রমশ কমেছে। গত বিধানসভায় দু’লক্ষ ৯ হাজার, লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে দু’লক্ষ ৬৮১ এবং উপনিবার্চনে এক লক্ষ ৮৬ হাজার ৪৮৭ মোট ভোট পড়েছিল। তার মধ্যে বিজেপি হিন্দু সমর্থনের উপরেই নির্ভরশীল ধরে নিলে সাদা চোখেই তাদের ভোট কমেছে। শতাংশের হিসেব তা-ই বলছে।

উপনির্বাচনের ক্ষুদ্র চিত্রে গেলে দেখা যাচ্ছে, কালীগঞ্জের ৩০৯টি বুথের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছে ১৯৮টিতে। বিজেপির জয় ১১০টি বুথে। কংগ্রেস এগিয়ে আছে কেবল একটিতে, ৯০ নম্বর বুথে ১০ ভোটে জিতেছে তারা। বিজেপি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৫০-এর কম, এমন বুথ ১৫৪টি। বোঝাই যাচ্ছে, এই ছবি মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলের। এই সব বুথে তৃণমূলের পরে দ্বিতীয় স্থানে আছেন বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী। তৃণমূল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ১০০-র নীচে, এমন বুথ ১৫টি। এই বুথগুলিতে বিজেপি প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান বেশি। কিন্তু বিজেপির জেতা অনেক বুথেই ছবিটা এমন নয়।

নেতাজি নগর পাড়ার পরপর ১৮৩, ১৮৪ ও ১৮৫ নম্বর বুথের কথা ধরা যাক। একই এলাকায় এই তিনের মধ্যে দু’টি বুথ বিজেপি জিতেছে, একটিতে এগিয়ে তৃণমূল। কিছু ভোট গিয়েছে কংগ্রেসের দিকেও। তৃণমূল প্রার্থী ১৬৩ নম্বর বুথে বিজেপির চেয়ে এগিয়ে আছেন মাত্র এক ভোটে! একই ভাবে ২৬০ নম্বর বুথে বিজেপি প্রার্থী তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে চার ভোটে, ২৬৪ নম্বর বুথে ৬ ভোটে। আবার ২৭২ নম্বর বুথে তৃণমূল প্রার্থী বিজেপিকে পিছনে ফেলেছেন চার ভোটে। হিন্দু ভোট একচেটিয়া ভাবে বিজেপির দিকে যায়নি, তেমন তথ্য প্রধান বিরোধী দলের জেতা বুথগুলির অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার।

কালীগঞ্জে উপনির্বাচন হয়েছিল মুর্শিদাবাদ ও মহেশতলার ঘটনার পরে। বিজেপির প্রচার ছিল চড়া হিন্দুত্বের তারে বাঁধা। তার জেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের দিকে সংখ্যালঘু ভোটের কার্যত মেরুকরণ হলেও তার বিপরীত মেরু সে ভাবে তৈরি হয়নি— অন্তত বুথের ছবি সে কথাই বলছে। ইদানিং‌ প্রবল হিন্দুত্বের উদগাতা, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ‘‘হিন্দুদের মধ্যেও একজোট হওয়া শুরু হয়েছে। তৃণমূলকে হারাতে গেলে যতটা দরকার, সেই জায়গায় এখনও যায়নি।’’আর তৃণমূলের বিজয়ী প্রার্থী আলিফা আহমেদের কথায়, ‘‘আমরাও অনেক হিন্দু ভোট পেয়েছি। যেমন, কালীগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েত হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা, সেখানে আমরা তিন হাজারের উপরে লিড পেয়েছি।’’ গোবরা-সহ আরও কিছু অঞ্চলের উদাহরণ দিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের ক্ষোভ, নিচু তলায় বাম-কংগ্রেস সমঝোতা মসৃণ হলে ‘নোটা’য় আড়াই হাজার ভোট পড়ত না! তবে সিপিএম ও কংগ্রেস নেতারা একই সঙ্গে বলছেন, বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের প্রচারে তাদের নিজেদের লাভ হচ্ছে কম। আখেরে শেষ হাসি হাসছেন মমতাই!

কালীগঞ্জের বুথ-চিত্র

মোট বুথ: ৩০৯

তৃণমূল কংগ্রেসের জয়: ১৯৮

বিজেপির জয়: ১১০

কংগ্রেসের জয়: ১

বিজেপির ভোট ৫০-এর নীচে: ১৫৪ বুথ

তৃণমূলের ভোট ১০০-র নীচে: ১৫ বুথ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP TMC CPIM Left Congress

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy