Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হেলদোল নেই কারও, অমূল্য রত্ন বন্দি কালিম্পঙের সিন্দুকে

গোয়েন্দারা বলছেন, তার আনুমানিক মূল্য অন্তত তিন কোটি টাকা। পুরাতত্ত্ববিদরা বলছেন, টাকার অঙ্কে এর মূল্য মাপা অসম্ভব। আদালত বলছে, এটি দেশের সম্পদ। অথচ এমন এক ‘অমূল্য’ জিনিসের আজ পর্যন্ত কোনও গতিই হয়নি! অ্যাডভেঞ্চার ফিল্মের চিত্রনাট্যকে হার মানানো দুরন্ত অভিযানে ২০০৪ সালে সেটি উদ্ধার করেছিল সিবিআই। কিন্তু তার পর আর দায় নিতে চায়নি কেউ। সরকারি কর্তারা এ-ওর কোর্টে বল ঠেলে গিয়েছেন।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

গোয়েন্দারা বলছেন, তার আনুমানিক মূল্য অন্তত তিন কোটি টাকা। পুরাতত্ত্ববিদরা বলছেন, টাকার অঙ্কে এর মূল্য মাপা অসম্ভব। আদালত বলছে, এটি দেশের সম্পদ।

অথচ এমন এক ‘অমূল্য’ জিনিসের আজ পর্যন্ত কোনও গতিই হয়নি! অ্যাডভেঞ্চার ফিল্মের চিত্রনাট্যকে হার মানানো দুরন্ত অভিযানে ২০০৪ সালে সেটি উদ্ধার করেছিল সিবিআই। কিন্তু তার পর আর দায় নিতে চায়নি কেউ। সরকারি কর্তারা এ-ওর কোর্টে বল ঠেলে গিয়েছেন। এই দীর্ঘসূত্রতায় কালিম্পং আদালতের মালখানার সিন্দুকে বছরের পর বছর তালাবন্দি হয়েই পড়ে রয়েছে ১০০০ বছরের পুরনো ‘গাইতংপা’।

কী এই ‘গাইতংপা’ বা ‘গেতংপা’?

এ হল তিব্বতি ভাষায় লেখা এক রকম বৌদ্ধ পুঁথি। এই পুঁথিতে লিপিবদ্ধ করা থাকে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র। ভারতে নালন্দা-সহ হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় গাইতংপা পুঁথি রয়েছে। এমনই এক দুষ্প্রাপ্য গাইতংপার সন্ধান অভিযানে সিবিআই জড়িয়ে পড়েছিল নেহাতই ঘটনাচক্রে।

২০০৪ সালের মাঝামাঝি। সিবিআই তখন হন্যে হয়ে খুঁজছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হারানো নোবেল পদক! গোয়েন্দারা সন্দেহ করছিলেন, নোবেল পদক সম্ভবত পাচার হয়ে গিয়েছে দেশের বাইরে। এই সময়েই সূত্র মারফত তাঁরা জানতে পারেন জনৈক ছেদিপ্রসাদ মণ্ডলের কথা। বিহারের ভাগলপুরের এই বাসিন্দা নাকি আন্তর্জাতিক চোরাচালানের খবরাখবর রাখেন। গোয়েন্দারা একটা আশার আলো দেখেন। ছেদির কাছ থেকে নোবেল পদকের খবর হয়তো মিললেও মিলতে পারে।

ক্রেতা সেজে সিবিআই অফিসারদের একটি দল পৌঁছয় ভাগলপুর। ছেদির কাছে খবর পাঠানো হয়, চুরি যাওয়া নোবেল পদক কিনতে তাঁরা আগ্রহী। কাটিহার স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে কথা হয় দু’পক্ষের। ছেদি বলেন, নোবেল পদক সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর দামে বিকোতে পারে, এমন একটি জিনিসের সন্ধান দিতে পারেন।

তখনই প্রথম জানা যায় ‘গাইতংপা’র কথা। ছেদি যে গাইতংপা পুঁথিটির কথা ছদ্মবেশী গোয়েন্দাদের বলেছিল, সেটি প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। চার ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া কাঠের তৈরি এই পুঁথির মোট ৩০৫টি পৃষ্ঠা। প্রতিটি পৃষ্ঠাই আদপে আলাদা আলাদা কাঠের পাটা। আগাগোড়া সোনার জলে লেখা। পুরু কাঠের তৈরি মলাটে বুদ্ধের মূর্তি খোদাই করে সূক্ষ্ম কাজ করা। পুঁথির ওজন প্রায় ৪০ কেজি। সিবিআই সূত্রই বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এর ঐতিহাসিক মূল্য। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-ও একই কথা বলছে।

ছেদিকে ফাঁদে ফেলে কালিম্পং থেকে শেষ পর্যন্ত এই গাইতংপা উদ্ধার করেছিল সিবিআই। গ্রেফতার করা হয়েছিল ছেদি-সহ তিন জনকে। গাইতংপার সঙ্গে উদ্ধার হয়েছিল রতি ও কামদেবের দু’টি ৪০০ বছরের পুরনো মূর্তি। সে সবই ভারতীয় জাদুঘরে সযত্নে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কালিম্পং আদালত। ২০১১ সালের সেই নির্দেশ আজও কার্যকর হয়নি। ওই অমূল্য পুঁথি ও মূর্তি এখনও অবহেলায় পড়ে রয়েছে কালিম্পং মালখানার সিন্দুকে। সিবিআইয়ের অভিযোগ, গত চার বছর ধরে বারবার ভারতীয় জাদুঘরকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাদের কোনও হেলদোল নেই। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সেই দায়ভার ঠেলে দিয়েছেন কালিম্পং পুলিশের দিকে। আর পুলিশের বক্তব্য, মামলা সিবিআইয়ের। কাজেই মূর্তি জাদুঘরে পাঠানোর দায়িত্বও তাদের।

কী করে উদ্ধার হল গাইতংপা?

সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, ছেদির কাছে খবর পেয়ে গাইতংপা কেনার ব্যাপারে উৎসাহ দেখান সিবিআই অফিসারেরা। ছেদি জানান, গাইতংপা রয়েছে কালিম্পঙে সুলেন লামা নামে এক বৃদ্ধের কাছে। এই সুলেন আদতে তিব্বতি লামা। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে তিব্বত আক্রমণ করেছিল চিন। সেই সময়ের পর থেকে বহু তিব্বতি পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে। সুলেন ১৯৫৯ সালে ভারতে চলে আসেন। সঙ্গে অন্যান্য নানা সামগ্রীর সঙ্গে এনেছিলেন এই গাইতংপা ও দু’টি মূর্তি। পরে তিনি তা বিক্রির চেষ্টা শুরু করেন। সেই খবরই পৌঁছয় ছেদির কাছে। আর ছেদির মাধ্যমে সিবিআইয়ের কাছে। ছদ্মবেশী সিবিআই অফিসারেরা ‌জিনিসটা দেখতে চান। তখন তাঁরা শোনেন, শুধু সিন্দুক খুলে গাইতংপা দেখানোর জন্যই ২৫ লক্ষ টাকা নেবেন সুলেন!

সিবিআইয়ের সেই দলটি এ বার কলকাতা থেকে পৌঁছে যায় কালিম্পং। শিলিগুড়িতে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ছেদি এবং তাঁর সঙ্গী শ্রীকান্তপ্রসাদ সিংহ। কালিম্পঙে গিয়ে তাঁরা দেখা পান বৃদ্ধ সুলেনের। মেয়ে-নাতি-নাতনির সঙ্গে যিনি তখন স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন কালিম্পঙের পশু হাসপাতালের পিছনের একটি বাড়িতে।

তৈরি হয়েই সুলেনের কাছে গিয়েছিল সিবিআই। সুলেন ২৫ লক্ষ টাকা দেখতে চান। ছদ্মবেশী সিবিআই অফিসারেরা ব্রিফকেস খুলে দেখান, থরে থরে নোট সাজানো। আসলে ওপরে নোট থাকলেও তলায় ছিল টাকার মাপে ফালি করে কাটা কাগজ। এক ঝলক দেখলে মনে হবে, টাকার তাড়া সাজানো রয়েছে। ধোঁকা খেয়ে যান সুলেন-ছেদি। সিন্দুক থেকে গাইতংপা বার করে সামনে রাখেন সুলেন। সেই পুঁথি মন দিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করেন অফিসারেরা। তার পর আচমকাই বের করেন রিভলভার।

সুলেন, ছেদি ও শ্রীকান্তকে গ্রেফতার করে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। ২০০৪ সালেই কালিম্পং আদালতে শুরু হয় বিচার। ২৫ দিন জেল খাটতে হয় সুলেনদের। বিচার চলাকালীন মারা যান বৃদ্ধ সুলেন। তখন তাঁর বয়স ৮৩। কয়েক বছর মামলা চলে। কিন্তু ২০১১ সালে সেই মামলা খারিজ করে দেয় কালিম্পং আদালত।

কেন খারিজ হল মামলা?

অভিযোগ, চার্জশিট জমা দেওয়ার সময়েই একটা ভুল করেছিল সিবিআই। নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের প্রাচীন জিনিসের পুরাতাত্ত্বিক মূল্য যাচাই করতে হয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর ডিরেক্টর পদমর্যাদার কোনও অফিসারকে দিয়ে। কিন্তু সিবিআই তার চেয়ে নিচু পদের অফিসারকে দিয়ে ওই পুঁথি যাচাই করিয়ে আদালতে সেই সংক্রান্ত নথি জমা দিয়েছিল। সেই কারণেই মামলাটি খারিজ করে দেয় কালিম্পং আদালত। ছেদি ও তাঁর সঙ্গী ছাড়া পেয়ে ফিরে যান ভাগলপুরে। তবে বাজেয়াপ্ত করা গাইতংপা ও মূর্তি ভারতীয় জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বলা হয়, এগুলি দেশের সম্পত্তি। ওই নির্দেশের একটি প্রতিলিপি পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাদুঘরের কাছেও।

জটিলতার শুরু এর পর থেকেই। সিবিআইয়ের বক্তব্য, আদালতের মালখানা থেকে জাদুঘরে গাইতংপা পৌঁছে দেওয়াটা তাদের কাজ নয়। সংস্থার আইনজীবী তাপস বসু জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশের পর বহু বার জাদুঘরের বিভিন্ন স্তরের অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি। কালিম্পং আদালতের মালখানার সিন্দুকের একটি চাবি এখনও রয়ে গিয়েছে তাপসবাবুর দেরাজে।

জাদুঘরের মুখপাত্র অশোক ত্রিপাঠী কার্যত হাত তুলে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের কাছে কালিম্পং আদালতের নির্দেশ পৌঁছেছে। কিন্তু নিয়ম তো হল, সেখানকার পুলিশ ওই জিনিসটি আমাদের কাছে পৌঁছে দেবে। আমাদের তো যাওয়ার কথা নয়।” দার্জিলিং জেলার পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদী বললেন, “জানি, ওই মূল্যবান জিনিস মালখানায় পড়ে রয়েছে। আমাদের তরফে সিবিআইকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কেউ আসেননি।” অখিলেশ জানালেন, তিনি নতুন করে সিবিআইকে চিঠি পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কাজেই গাইতংপা কবে আলোর মুখ দেখবে, কবে জাদুঘরে ঠাঁই পাবে, সেই সব প্রশ্নের দামও এখন কোটি টাকা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE