আগামী ১ অগস্ট থেকে পশ্চিমবঙ্গে আবার ১০০ দিনের কাজ শুরু করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারকে এমনটাই নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, ১০০ দিনের কাজ শুরু করার জন্য যে কোনও শর্ত আরোপ করতে পারবে কেন্দ্র। কিন্তু কাজ আটকে রাখা যাবে না। বুধবার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি চৈতালি চট্টোপাধ্যায় দাসের ডিভিশন বেঞ্চে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানি ছিল। সেখানেই আদালত এই নির্দেশ দিয়েছে।
রাজ্যে গত তিন বছর ধরে ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে, যা নিয়ে সরব বাংলার শাসকদল তৃণমূল। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে দিয়েছে। অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রের দেওয়া ১০০ দিনের কাজের টাকা নিয়ে বিস্তর দুর্নীতি হয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগীদের বঞ্চিত করে ওই টাকা অন্যদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। এই যুক্তিতেই এ রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ টাকা আটকে রেখেছিল কেন্দ্র। হাই কোর্টে এই মামলা বিচারাধীন। আদালত জানিয়েছে, দুর্নীতি রুখতে রাজ্য সরকারকে যে কোনও শর্ত দিতে পারবে কেন্দ্র। তবে ১০০ দিনের কাজ আবার শুরু করতে হবে। সমগ্র প্রকল্পটিকে বন্ধ করে রাখা যাবে না। প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এই সংক্রান্ত সমস্ত অভিযোগ ২০২২ সালের আগের। সেই সব নিয়ে আপনারা যা খুশি পদক্ষেপ করুন। কিন্তু এখন প্রকল্পের কাজ চালু করা হোক।’’
কেন্দ্রের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল (এএসজি) অশোককুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওই প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ নিয়ে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় দল জেলায় জেলায় গিয়েও সেই তথ্য তুলে এনেছে।’’ হাই কোর্ট জানায়, যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে।
আরও পড়ুন:
১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কেন্দ্রীয় দল এ রাজ্যে এসেছিল। তারা হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, মালদহ এবং দার্জিলিং— এই চার জেলায় ‘৫০০ লক্ষেরও’ (৫০ কোটি) বেশি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল। বুধবার প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, বাংলায় ১০০ দিনের কাজ নিয়ে একাধিক বার হাই কোর্টে শুনানি হয়েছে। রাজ্যের দুর্নীতি, অনিয়ম বা কেন্দ্রীয় দল নিয়ে আদালত কিছু বলছে না। কিন্তু যাঁরা কাজ করতে পারছেন না বা কাজ করেও যাঁরা প্রাপ্য টাকা পাচ্ছেন না, তাঁদের কেন ভুগতে হবে? কাজ কেন আটকে রাখা হবে? প্রয়োজনে যে চার জেলা থেকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, সেই জেলা বাদ দিয়ে বাকি অংশে ১০০ দিনের কাজ চালু করা হোক! এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, যার পুরো টাকাই দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সরাসরি শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যায়। জনস্বার্থে এই কাজ চালু হওয়া দরকার।
দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে আদালত জানিয়েছে, ১০০ দিনের কাজের জন্য বরাদ্দ টাকা কোথায় কী ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোথাও দুর্নীতি হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য কেন্দ্রের পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। কেন্দ্র তা দেখুক। তাতে আদালত বাধা দেবে না। কিন্তু এই কাজ চালু রাখতে হবে। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এ-ও জানায়, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা আইনের (মনরেগা) কোথাও বলা নেই যে, অর্থের অনিয়ম হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকবে। আদালত শুধু অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সীমারেখা টানতে চায়। আইনটির উদ্দেশ্য কার্যকর করতে চায়। আদালত আরও জানায়, অতীতে যা ঘটেছে তা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে।
১০০ দিনের কাজ নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ খেতমজুর সমিতি। আইনজীবী বিকাশরঞ্জয় ভট্টাচার্য, শামিম আহমেদ তাদের হয়ে এই মামলা লড়ছেন। অভিযোগ, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের কাজের মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। মামলাকারীদের আবেদন, এখনও পর্যন্ত যা বকেয়া মজুরি, সেই টাকা অবিলম্বে মিটিয়ে দেওয়া হোক। সেই সঙ্গে এত দিন টাকা বন্ধ করে রাখার জন্য ০.০৫ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হোক। এ ছাড়া, একই বিষয়ে হাই কোর্টে পৃথক মামলা করেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। তাই সিবিআই তদন্তের আবেদনও জানান চান শুভেন্দু।
১০০ দিনের কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, প্রকৃত জব কার্ড হোল্ডারদের অধিকাংশই এই প্রকল্পের সুবিধা পাননি। মৃত ব্যক্তিদের নামে টাকা নেওয়া হয়েছে। এমনকি, নকল বাঁধ তৈরি করেও টাকা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাজ্যে দল পাঠায় কেন্দ্র। ২০২৪ সালে পঞ্চায়েত এবং গ্রামীণ উন্নয়ন দফতরের সচিব হলফনামা দিয়ে জানান, ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রীয় দল ৬১৩ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে। তার মধ্যে রাজ্য ২১০.৩৫ লক্ষ টাকা উদ্ধার করেছে। এর পর আদালতের নির্দেশে একটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, যারা জেলা অনুযায়ী প্রকৃত উপভোক্তাদের তথ্য যাচাই করবে। কমিটিতে রাখা হয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এক জন করে প্রতিনিধি। এ ছাড়া ক্যাগ (অডিটর অ্যান্ড কম্পট্রোলার জেনারেল) এবং অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের এক জন করে প্রতিনিধি এই কমিটিতে রাখা হয়। ২০২৫ সালের এপ্রিলে এই যাচাই কমিটি হাই কোর্টে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগের ঘটনায় চার জেলা থেকে ‘২৪০ লক্ষ টাকা’ (২৪ কোটি টাকা) উদ্ধার করা হয়েছে। তখনও চার জেলা বাদে রাজ্যের বাকি অংশে ১০০ দিনের কাজ শুরু করা যায় কি না, প্রশ্ন তুলেছিল আদালত। অবশেষে এই সংক্রান্ত মামলায় কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হল কেন্দ্রকে।