২০০৯-এর ২৬ অগস্টের আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় এই ছবি-সহ বেরিয়েছিল জয়শ্রী-বরুণের দুর্ঘটনার খবর।
একটা হাত হারিয়ে তাঁর জীবনটা পাল্টে গিয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সে। এর সাত বছর পর মৃত্যু যখন শিয়রে, তখন নিজের কৃত্রিম হাতটি দিয়ে নতুন দিক নির্দেশ করে গিয়েছেন তিনি।
যে সময়ে মরণোত্তর অঙ্গদান নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে বারবার, ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করে মরণোত্তর দেহদানের পরিকাঠামো তৈরি করতে না-পারার জন্য রাজ্য সরকারকে সমালোচিত হতে হচ্ছে, সেই সময়ে তিনি মরণোত্তর কৃত্রিম অঙ্গদানের মতো অবহেলিত, অনালোচিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে সামনে এনে ফেলেছেন।
তাঁর নাম জয়শ্রী চক্রবর্তী। মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ। বেহালার পর্ণশ্রী এলাকায় থাকতেন স্বামী বরুণ কুমার চক্রবর্তী আর একমাত্র ছেলে শুভদীপকে নিয়ে। নিজের জীবন দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন অঙ্গহানির অসহায়তা। তাই সেই সাহায্যটাই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন অন্য কোনও সহায়হীনকে। তাঁর শেষ ইচ্ছা
হিসেবে তাঁর কৃত্রিম হাত দান করা হচ্ছে মরণোত্তর।
২০০৯ সালের ২৫ অগস্ট। কলকাতার রাস্তায় দুই বাসের রেষারেষিতে একই সঙ্গে ডান হাত কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল জয়শ্রীদেবী ও তাঁর স্বামীর। শুভদীপের বয়স তখন পাঁচ। সে-ও বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল। তবে তার কোনও অঙ্গহানি হয়নি। প্রায় চার মাস এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। জয়শ্রীর আঘাতের তীব্রতা ছিল মারাত্মক। ডান কাঁধের মাংস এতটাই কাটতে হয়েছিল যে, সাধারণ নকল হাত বসানো যাচ্ছিল না। টানাটানির সংসারে অত্যাধুনিক হালকা হাতের জন্য লাখ দেড়েক টাকা জোগাড় করতে পারেননি ওই দম্পতি।
পর্ণশ্রীর বাড়িতে বসেই বরুণবাবু বলছিলেন তাঁদের অমানুষিক লড়াইয়ের কথা। দু’জনেরই ডান হাত কাটা এবং বাড়িতে ছোট বাচ্চা। বাড়ি সামলানো, অফিস সামলানো, বাচ্চা সামলানো এবং পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। বাঁ হাতে লেখা-রান্না থেকে শুরু করে সব কিছু করতে শেখা। ‘‘আমি কেঁদে ফেলতাম, ভরসা হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু জয়শ্রীর অসম্ভব জেদ আর ধৈর্য। এক বছরের ভিতর বাঁ হাতে ও অনেকটা সড়গড় হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা হাসিমুখে মানিয়ে নিত।’’
জীবনের পরীক্ষা তার পরেও বাকি ছিল। ২০১১ সালে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ল জয়শ্রীদেবীর। শুরু হল আর এক লড়াই। আমরি হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় ভয়াল অগ্নিকাণ্ড থেকে একটুর জন্য প্রাণে বাঁচলেন। একটি সংস্থা বরুণবাবুকে একটি কৃত্রিম হাত কিনে দিয়েছিল। জয়শ্রীর দরকার ছিল একটু আধুনিক হালকা কৃত্রিম হাত, যা দিয়ে তিনি ঘরের কাজকর্ম, রান্না, শাড়ি পরার মতো কাজ করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে যাদবপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য সুশান্ত বল, শুক্লা বলের সাহায্যে জার্মানিতে তৈরি প্রায় পৌনে দু’লাখ টাকা দামের হাত লাগানো হয় জয়শ্রীর শরীরে। উজ্জ্বল হেসে জয়শ্রী সে দিন বলেছিলেন, পরমুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকাকে ঘেন্না করেছেন চিরদিন। নকল হাতটা মেরুদণ্ড সোজা করে বেঁচে থাকার সেই চেষ্টাকে জিতিয়ে দিল।3
জয়শ্রীর নকল হাতটি দান করার আগে বরুণবাবু। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কিন্তু হারানো গেল না ক্যানসারের ছোবলকে। এ মাসের ১০ তারিখ ক্যানসারেই মারা গিয়েছেন জয়শ্রী। মৃত্যুশয্যাতেই স্বামীকে জানিয়েছিলেন শেষ ইচ্ছার কথা— তাঁর কৃত্রিম ডান হাতটি যেন দেওয়া হয় কোনও প্রতিবন্ধী মানুষকে। সেই মতোই ২০ তারিখ তাঁর শ্রাদ্ধের দিনটিতেই হাতটি দান করে দেওয়া হয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে।
বরুণবাবু বলে যাচ্ছিলেন, অসংখ্য মানুষের প্রস্থেটিক্স বা কৃত্রিম হাত-পা দরকার। কিন্তু কেনার সামর্থ্য নেই। একটু ভাল মানের প্রস্থেটিক্সের কয়েক লক্ষ টাকা দাম। সরকারি হাসপাতালে এ সব নিখরচায় পাওয়ার কথা। কিন্তু তার জন্য বছরের পর বছর খাতায় নাম তুলে অপেক্ষায় থাকতে হয়। মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের মতোই কৃত্রিম অঙ্গদানও অনেককে নতুন জীবন দিতে পারে। বরুণবাবুর কথায়, ‘‘৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের বেডে শুয়েই জয়শ্রী বলেছিল, আমার তো ক্যানসার, আইনত আমার দেহ দান করা যাবে না। আমার নকল হাতটা দিয়ে গেলাম। ওটাও তো আমারই অংশ।’’
আমেরিকা ও ইউরোপে এই কৃত্রিম অঙ্গদান যথেষ্ট জনপ্রিয়। আমেরিকার ন্যাশভিল অঞ্চলের বাসিন্দা গ্রেসি’র ১৭ বছর বয়সে দু’টো পা কাটা যায়। নকল পায়ে নতুন জীবন শুরু করেন। এখন স্বামী পিটার রোজেনবার্গারের সঙ্গে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান গ্রেসি। তার কাজই হল মৃত মানুষদের কৃত্রিম হাত-পা-পেসমেকার প্রভৃতি গরিবদের নিখরচায় দেওয়া। মূলত আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে তাঁরা ব্যবহৃত কৃত্রিম পা ও হাত পাঠান। কিন্তু এ দেশে এখনও এর চল শুরু হয়নি তেমন।
জয়শ্রীর কাহিনি শুনে অভিভূত দীর্ঘদিন মরণোত্তর অঙ্গদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্রজ রায়। বললেন, ‘‘এত দিন আন্দোলন চালিয়েছি। কিন্তু মরণোত্তর কৃত্রিম অঙ্গদানের দিকটা কখনও ভাবিনি। চোখ খুলে দিলেন জয়শ্রী।’’ একই কথা বললেন তামিলনাড়ুর অশোকন সুব্রহ্মণ্যম। ২০০৮ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর ১৫ বছরের ছেলে হিতেন্দ্রনের ‘ব্রেন ডেথ’ হয়। তখন অশোকন ও তাঁর স্ত্রী পুষ্পাঞ্জলির সম্মতিতে হিতেন্দ্রনের একাধিক অঙ্গ দিয়ে দেওয়া হয়। এর পরই অশোকন জড়িয়ে পড়েন মরণোত্তর অঙ্গদান আন্দোলনে। টেলিফোনে তিনিও বলেন, ‘‘নতুন ভাবনার দিক খুলে গেল। এটা নিয়ে তো চিকিৎসক মহল, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা সরকার— কেউ তেমন ভাবে ভাবেনি। মরণোত্তর কৃত্রিম অঙ্গদান শুরু হলে কত মানুষই তো বাঁচার উপকরণ পাবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy