Advertisement
E-Paper

আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন না, স্যার

শীত-সকালের আড়মোড়া ভেঙে সদ্য চেয়ারটা টেনে বসেছেন থানার ডিউটি অফিসার। ‘কই রে, এক কাপ চা পাঠিয়ে দিস’ বলে নিজের ঘরে ঢুকেছেন ওসি। অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে সীমান্তঘেঁষা হোগলবেড়িয়া থানা চত্বরে এক-এক করে আসতে শুরু করেছেন লোকজনও।

গৌরব বিশ্বাস ও কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:৩১
হোগলবেড়িয়া থানায় ওঁরা দু’জনে।— নিজস্ব চিত্র

হোগলবেড়িয়া থানায় ওঁরা দু’জনে।— নিজস্ব চিত্র

বড়জোর সাতটা-সাড়ে সাতটা।

শীত-সকালের আড়মোড়া ভেঙে সদ্য চেয়ারটা টেনে বসেছেন থানার ডিউটি অফিসার। ‘কই রে, এক কাপ চা পাঠিয়ে দিস’ বলে নিজের ঘরে ঢুকেছেন ওসি। অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে সীমান্তঘেঁষা হোগলবেড়িয়া থানা চত্বরে এক-এক করে আসতে শুরু করেছেন লোকজনও।

হঠাৎই এক তরুণীকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকলেন এক যুবক। ‘কী ব্যাপার!’ হেঁকে প্রহরী ছুটে আসার আসেই তাঁরা পৌঁছে গিয়েছেন সটান ডিউটি অফিসারের টেবিলে। কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই হাঁফাতে হাঁপাতে ছেলেটি বলে চলে, ‘‘বাঁচান স্যার। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা দু’জন দু’জনকে ভালবাসি। কিন্তু ভিন্ন জাত বলে বাড়ির আপত্তি রয়েছে। আমরা বিয়ে করতে চাই। কিছু একটা করুন স্যার। আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন।’’

প্রথমে হকচকিয়েই গিয়েছিলেন মাঝবয়সী ডিউটি অফিসার। চুরি, ডাকাতি, খুন কিংবা নেহাত ‘পেটি কেস’ তো নয়, এক্কেবারে ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’। সঙ্গে দোসর আবার ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। কিন্তু পোড় খাওয়া পুলিশের তো ঘাবড়ালে চলবে না। জল কোন দিকে গড়াচ্ছে সেটা বুঝতে তিনিও হাঁক পাড়লেন, ‘‘এখানেও দু’টো চা পাঠিয়ে দে বাবা।’’ চায়ে গলা ভিজলেও চিঁড়ে কিন্তু ভেজেনি। নাছোড় যুগলের সেই এক আর্তি, ‘‘আপনারা আমাদের পাশে না দাঁড়ালে খুব বিপদ হয়ে যাবে। কিছু একটা করুন স্যার।’’

বছর চব্বিশের মন্টু দাস আর বছর কুড়ির অণিমা প্রামাণিক। বাড়ি করিমপুরে। মন্টু ছাত্রছাত্রী পড়ান। অণিমা নদিয়ার এক কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ফেসবুকের সৌজন্যে পরিচয়। ফোন নম্বর লেনদেন, ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা। তবে বছর খানেকের এই সম্পর্কের কথা গোপন থাকেনি অণিমার বাড়িতে। মন্টুর বাড়িতে কেউ রা না কাড়লেও আপত্তি ওঠে অণিমার পরিবারের তরফে।

অণিমাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘‘আর যাই হোক, নিচু জাতের ছেলের সঙ্গে বিয়ে নয়।’’ থানার ডিউটি অফিসারের ঘরে মন্টুর পাশে বসে অণিমা প্রশ্নটা করেই ফেলেন, ‘‘আজকাল কি আর কেউ জাতপাত মানে নাকি? কিন্তু বাড়িতে বলেও কোনও লাভ হয়নি।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে বাড়ির লোকজন আমাকে কার্যত বন্দি করে রেখেছিল। কলেজ-টিউশন সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’’ তার পরেই তিনি ঠিক করে ফেলেন, বাড়ি থেকে পালাবেন। সেই মতো মন্টুকে ফোন করে বেরিয়েও পড়েন। কিন্তু বিয়ে করতে মন্দিরে বা ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে না গিয়ে থানায় কেন? ওসি কি পুরুত?

প্রায় সমস্বরে দু’জনে বলে ওঠেন, ‘‘ভয়! পালিয়ে গেলেও বাড়ির লোক ঠিক আমাদের খুঁজে বের করত।’’ এ দেশে ভিন্ জাতে ভালবাসার মাসুল দেওয়ার নজির কম নেই। এ রাজ্যে পরিবারের মর্যাদারক্ষার নামে পাত্র-পাত্রীকে খুন করার ইতিহাস না থাকলেও জোর করে দু’জনকে আলাদা করে দেওয়া বা রাতারাতি অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে ফেলার ঘটনা হামেশাই ঘটছে। রিজ-প্রিয়ঙ্কার ঘটনা তো এখনও বহু নাগরিকের স্মৃতিতে অমলিন। মন্টু-অণিমার ভয় যে অমূলক নয় তা মানছে হোগলবেড়িয়া থানার পুলিশও। তাঁর কথায়, ‘‘ওই দু’জনের মুখ থেকেই গোটা ঘটনাটা শুনেছি। সমস্যা মেয়েটির বাড়ি থেকেই, আর সেটা জাতপাত নিয়েই। এ সব ক্ষেত্রে পরিণতি অনেক সময়েই ভাল হয় না।’’ মেয়েটির বাবা-মা জাতপাতের বিষয়টি মানতে না চাইলেও অণিমার এক আত্মীয় কবুল করেন, ‘‘সত্যি বলতে, আমাদের গ্রামের দিকে জাত তো একটা ব্যাপার বটেই। ছেলেটা ভাল কিছু কাজ করলেও না হয় কথা ছিল। খালি তো ছাত্র পড়ায়!’’

বিয়েতে বাধা দেওয়ার পরিণতি যে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে তা ভাবতে পারেনি ওই তরুণীর পরিবার। এ দিন অণিমার এক আত্মীয় বলেন, ‘‘মেয়ে সাবালিকা হলেও ওর বুদ্ধি হয়নি। পড়াশোনা শেষ করলেই মন্টুর সঙ্গেই ওর বিয়ে দেব।’’ থানায় গিয়ে বাড়ির লোকজন তাকে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েওছেন। তবু মঙ্গলবার দিনভর অণিমাকে টলানো যায়নি। মন্টুর পরিবার দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। বলে দিয়েছে, ‘‘ওকে বৌমা বলে মানতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’’

নদিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) তন্ময় সরকার বলেন, ‘‘প্রাপ্তবয়স্ক দুই তরুণ-তরুণী বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাধ সাধছে পরিবার। সেই কারণে তাঁরা থানায় এসেছেন সাহায্যের জন্য। ওঁরা যাতে কোনও বিপদে না পড়েন, সে জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

পুলিশ কিন্তু পড়েছে বেকায়দায়। তাদের চোর-ডাকাত-খুনি সামলানো অভ্যেস। প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে তারা করে কী? দু’জনেই সাবালক, কারও কোনও অভিযোগও নেই যে দুম করে মামলা ঠুকে গারদে পুরে দিলেই চলবে। কোথায় এদের থাকতে দেওয়া হবে? খেতেই বা দেওয়া হবে কী?

ভেবেচিন্তে শেষমেশ দু’জনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে থানার ডিউটি অফিসারের ঘরে। টিফিন, চা-বিস্কুট পুলিশই জুটিয়েছে। তবে ছেলে আর ভাবী বৌমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন মন্টুর মা। পাশাপাশি বসে দু’টিতে দিব্যি খেয়েছেন। টুকটাক গল্পগুজব, খুনসুটিও করেছেন। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁদের কাউকেই বাড়ি ফেরানো যায়নি। থানাতেই তাঁরা দিব্যি আছেন।

সব দেখে-শুনে এখন দাঁতে নখ কাটছে পুলিশও। সীমান্তের বেশ কয়েকটি ‘থানা-খাটা’ এক কনস্টেবল তো কিঞ্চিৎ বলেই ফেলেন, ‘‘বিয়ে করতে চেয়ে থানায় আসা কেস এই প্রথম দেখলাম। আমাদের বাপু এত সাহস থাকলে জীবনটাই অন্য রকম হয়ে যেত!’’

(যুগলের নাম পরিবর্তিত)

state news different caste
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy