Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Crime

দশ টাকার নোটে হিসেব লিখে হাতবদল হত গরু

২০১৮ সালের মাঝামাঝি গোয়েন্দারা জানতে পারেন, গরু পাচারকারীদের নানা হিসেব-নিকেশ, সঙ্কেত লেখা হচ্ছিল দশ টাকার নোটের গায়ে।

নোটে লেখা হিসেব। নিজস্ব চিত্র

নোটে লেখা হিসেব। নিজস্ব চিত্র

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:২৬
Share: Save:

বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল দশ টাকার নোট। এ দিকে, নতুন চালু হওয়া দশ টাকার কয়েন নিতেও অনেকের আপত্তি। কেনাবেচায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, ডোমকল, রানিনগরের মতো এলাকাগুলিতে। ২০১৬-১৭ সাল নাগাদ ওই ঘটনায় পুলিশকে পথে নামতে হয়। তাদের চাপে পড়ে কয়েন হাত বদল সহজ হয়ে আসে।

কোথায় যাচ্ছিল দশ টাকার নোট? ২০১৮ সালের মাঝামাঝি গোয়েন্দারা জানতে পারেন, গরু পাচারকারীদের নানা হিসেব-নিকেশ, সঙ্কেত লেখা হচ্ছিল দশ টাকার নোটের গায়ে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই এলাকাগুলিতে তখন গরু পাচারের এতটাই রমরমা, তার জেরে বাজারে টান পড়ে দশ টাকার নোটের।

কী ভাবে ব্যবহার হত ওই নোট?

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, দশ টাকার নোটের উপরে ক’টা গরু পাচার হচ্ছে, তাদের সাইজ কেমন, কোন তারিখে পাচার হচ্ছে, সে সব নানা খুঁটিনাটি লিখে রাখা হত। এর আগে সীমান্তবর্তী এলাকায় নানা সময়ে পাচারের কাজে ছোট চিরকুট, কাগজের টুকরো ব্যবহার করতে দেখেছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু কেন তার জায়গা দখল করল দশ টাকার নোট? তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, চিরকুটে লেখাপত্রের হিসেবে গরমিল হচ্ছিল। নোট ব্যবহারে সুবিধা হল, নোটের সংখ্যা লিখে রেখে হিসেব মেলানো সহজ ছিল। কেনাবেচায় জল মেশানো রুখতেই পাচারকারীরা দশ টাকার নোট কাজে লাগাতে শুরু করে। ব্যাঙ্ক থেকেও সব দশ টাকার নোট তুলে নিত তারা।

আরও পড়ুন: গরু পাচার: বিপুল সম্পত্তির হদিস পেল সিবিআই

গরু পাচার নিয়ে তদন্তে সিবিআই জানতে পেরেছে, ২০১৫-’১৭ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের গরু পাচার সিন্ডিকিটের চাঁই এনামুল-আনারুলদের সঙ্গে সরাসরি বোঝাপড়া ছিল সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কম্যান্ডান্ট সতীশ কুমারের। গরু পাচার রীতিমতো সংগঠিত রূপ পায় সে সময়ে। পাচারকারীদের দুশ্চিন্তা কমেছিল। বাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত ভাবে ‘খুশি করা’র ঝক্কি কমেছিল। তখনই ঠিক হয়েছিল, দশ টাকার নোটই হবে পাচারের ছাড়পত্র।

এক সময় এনামুলের সিন্ডিকেটে কাজ করতেন রানিনগরের ইফতিকার শেখ (নাম পরিবর্তিত)। বর্তমানে গৃহশিক্ষকতা করেন। একবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিলেন। বিএসএফের সঙ্গে পাচারকারীদের বোঝাপড়ার দিকটি কাছ থেকে দেখেছেন। ইফতিকার বলেন, “দশ টাকার নোটে লেনদেন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত বিএসএফ-শুল্ক দফতর এবং পুলিশের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বোঝাপড়া করতে হত। কখনও হাতে লেখা কার্ড, কখনও নির্দিষ্ট ছবিওয়ালা কাগজ ছিল পাচারের ছাড়পত্র। কিন্তু মাসের শেষে হিসেবে জল মিশত। বখরা নিয়ে গোলমাল হত। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, পুলিশ, শুল্ক বিভাগ এবং বিএসএফের সঙ্গে দশ টাকার নোটে ডিল হবে।” তবে বিএসএফের কোন কোন কর্তার সঙ্গে এনামুলদের বোঝাপড়া ছিল, তা জানতেন না বলেই দাবি ইফতিকারের।

আরও পড়ুন: ২০১৭-য় এনামুল ৭ কোটি টাকা আয়কর জমা দিয়েছিলেন!

তিনি জানালেন, যারা গরু নিয়ে সীমান্তের ও পারে যেত, তাদের বলা হত ‘পাসার’। বিএসএফের কাছে নাম ছিল ‘হ্যান্ডলার’। একটি লরিতে করে গরু পদ্মার পাশের গ্রামগুলিতে এনে বিভিন্ন বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হত। এক এক জন পাসারের দায়িত্বে থাকত ২ থেকে ৬টি গোরু। দশ টাকার নোটে তা বিস্তারিত লেখা থাকত। অর্থাৎ, কোনও পাসারের হাতে চারটি গরু থাকল, তা নোটের উপরে লেখা হত। গরু ছোট-বড় না মাঝারি, তা-ও লেখা থাকত। পরে রাতের অন্ধকারে সেই গরুই পাঠিয়ে দেওয়া হত সীমান্তের ও পারে। গরুর মাপ অনুযায়ী বখরা মিলত। পাচারের তারিখও উল্লেখ থাকত নোটে। কখনও কখনও কোন ট্রাকে সেই গরু এসেছিল, তার নম্বরও উল্লেখ থাকত।

নোটের নম্বর পাচারের সময়ে টুকে রাখত পুলিশ, শুল্ক দফতর। সব শেষে তা জমা পড়ত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে। মাসের শেষে তা যেত এনামুলদের কাছে। ফলে সারা মাসে ক’টি কোন সাইজের গরু হাত বদল হল, তার হিসেব ঠিকঠাক মিলে যেত। নোটের নম্বর মিলিয়ে গরু-পিছু টাকা বিলি-বণ্টন হত। কোনও তরফ থেকেই হিসেবের গরমিলের সুযোগ ছিল না।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে গরু পাচারের এই ব্যবস্থায় ভাটা পড়ে। তা ছিল সীমান্তে নজরদারি বাড়ার ফল। তবে পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় ফিরবে, বার বারই আশ্বাস দিত পাচারকারীরা। ‘উপর মহল’ থেকেই মিলত সেই আশ্বাস, মনে করেন ইফতিকার। তবে তাঁর দাবি, সে সময় থেকেই তিনি সরে আসেন বেআইনি কারবার থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE