এত দিন দরজায় ক়ড়া নেড়েছে। এ বার নিচুতলার অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সারদা-মামলার সূত্রে সরাসরি রাজ্য সরকারের অন্দরেই ঢুকে পড়ল সিবিআই! ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠানো নিচুতলার কিছু ফাইল পরীক্ষার ইঙ্গিতও তারা দিয়ে রেখেছে, যার জেরে সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের উঁচু মহলে।
নবান্নের খবর: দিন কয়েক আগে রাজ্য অর্থ দফতরের অধীনস্থ আর্থিক অপরাধ দমন শাখার দুই অফিসারকে ডেকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওঁদের কাছে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর মূল জিজ্ঞাস্য ছিল, সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এলেও রাজ্য কেন তদন্ত করেনি। হাত গুটিয়ে থাকার নেপথ্যে কোনও ‘প্রভাবশালী’ মহলের চাপ ছিল কিনা, কথাবার্তার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তারও আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সিবিআই-সূত্রের দাবি: সারদা-কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার দু’বছর আগেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর সারদার মতো সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তে নামার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তাগাদা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজ্যের তরফে উদ্যোগ দেখা যায়নি। কেন যায়নি, তার ব্যাখ্যা চেয়ে দিল্লি অন্তত ১২টি চিঠি দিয়েছিল। শেষমেশ গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি রাজ্য তার জবাব দিয়েছে। সেখানেই অর্থ দফতরের অধীনস্থ আর্থিক অপরাধ দমন শাখার (ইকনমিক অফেন্স উইং) উল্লেখ রয়েছে। সেই সূত্রে উইংয়ের দুই অফিসারকে ডেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা কয়েকটা বিষয় জানতে চেয়েছেন। প্রয়োজনে তাঁদের ফের ডাকা হবে বলে জানিয়ে রেখেছেন সিবিআই-কর্তারা।
নবান্নের খবর: যাঁদের তলব করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন উইংয়ের দুই সাব-ইন্সপেক্টর। ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তাঁদের ঘণ্টা দুয়েক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি: সরাসরি সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে ওঁদের প্রশ্ন করা হয়নি। সিবিআই মূলত জানতে চেয়েছিল, রাজ্যের এই শাখাটি কবে থেকে কী কাজ করছে, এবং অবৈধ লগ্নি সংস্থার রমরমা ঠেকাতে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে। কোনও ব্যবস্থা না-নিয়ে থাকলে তার কারণই বা কী? উইংয়ের কাজকর্ম সম্পর্কে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী কারা, তাও সিবিআই জানতে চায় দুই অফিসারের কাছে।
উত্তরে কী বলেছেন ওঁরা?
সূত্রের খবর: ওঁরা সিবিআই-কে জানিয়েছেন, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। কেননা তেমন কোনও আইন এখনও রাজ্যের অধরা। অভিযোগ পেলে তাঁরা বিস্তারিত খোঁজ-খবর করে অর্থ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক যুগ্ম-সচিবকে রিপোর্ট দিয়ে থাকেন। এর পরে দফতরের কাছ থেকে যেমন যেমন নির্দেশ আসে, সেই মতো পদক্ষেপ করা হয়। গত তিন-চার বছরে উইং এমন কী কী ‘পদক্ষেপ’ করেছে, সিবিআই অফিসারেরা দু’জনের মুখে তা-ও শোনেন।
কেন্দ্রীয় ব্যুরোর এ হেন ‘খোঁজ-খবরের’ বহর দেখে শঙ্কিত রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহল। এক আমলার মন্তব্য, ‘‘আগে সিবিআই শুধু চিঠি দিচ্ছিল। এই প্রথম সরকারি অফিসারদের জেরা করল। পরিস্থিতি সুবিধার ঠেকছে না।’’ প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সারদা-কাণ্ডে ‘প্রভাবশালী’দের ভূমিকাও সিবিআই-তদন্তের আওতায়। নবান্নের একাংশের পর্যবেক্ষণ: নিচুতলার মুখ থেকে সিবিআই মালুম করতে চাইছে, অবৈধ লগ্নি সংস্থাগুলি সম্পর্কে রাজ্যের কাছে কতটা খবর ছিল, এবং তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ করা বা না-করার পিছনে ‘বিশেষ’ কারও নির্দেশ ছিল কি না।
বস্তুত সিবিআইয়ের বক্তব্যেও এই ভাবনার সমর্থন। ‘‘রাজ্যের পাঠানো রিপোর্টই বলছে, বেআইনি লগ্নি সংস্থার কাজ-কারবার সম্পর্কে অনেক কিছু খবর ছিল। তবু রাজ্য নড়ে-চড়ে বসেনি। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি, এর পিছনে কোনও নির্দেশ ছিল কি না।’’— বলছেন এক সিবিআই-কর্তা। ব্যুরোর এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘উইং নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দুই অফিসার স্বীকার করেছেন, অভিযোগ সম্পর্কে যথাকর্তব্য জানতে অর্থমন্ত্রীর কাছে ফাইল গিয়েছিল।’’ তাই দরকারে এ সংক্রান্ত ফাইলপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথাও সিবিআই ভাবছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
রাজ্য সরকারের কী বক্তব্য?
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। তবে তাঁর দফতরের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, ‘‘সরকার চিঠি দিয়ে সিবিআই’কে বিস্তারিত জানিয়েছে। তদন্তে সহযোগিতাও করছে।’’ কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা অবশ্য মনে করছেন, রাজ্য সরকার নেহাত চাপে পড়েই সিবিআই’কে ওই চিঠি লিখেছে। কারণ, সিবিআই সরাসরি খোদ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিবের কাছে জানতে চেয়েছিল, বারবার তাগাদা সত্ত্বেও সরকার কেন জবাব দিচ্ছে না।
রাজ্যের দেওয়া জবাবি-চিঠিতে কী রয়েছে? তাতে বলা হয়েছে, ২০১১-য় কংগ্রেস এমপি আবু হাসেম খান চৌধুরী যে ধরনের অভিযোগ তুলেছিলেন, তেমন আরও অভিযোগ সরকারের কাছে আগেই জমা পড়েছিল। ‘মাল্টি লেভেল মার্কেটিং’-এর নামে কিছু কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে কী ভাবে টাকা তুলছে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা সে বিষয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট ২০০৯ সালেই দিয়েছিলেন, যাতে সারদা রিয়েলটির নাম ছিল।
রাজ্যের দাবি, প্রাথমিক খোঁজ-খবর করে ২০১০-এর ২৩ এপ্রিল রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)-কে চিঠি পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সেবি-কেও জানানো হয়। ‘এর পরে ২০১১-র ১০ অক্টোবর সারদা-সহ কিছু সংস্থার বেআইনি আমানত সংগ্রহ সম্পর্কে রাজ্যকে হুঁশিয়ার করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চিঠি দিয়েছিল। ২০১২-র ১০ এপ্রিল অর্থ দফতরও সারদা সম্পর্কে অভিযোগ পায়, সরাসরি আমানতকারীদের কাছ থেকে। অভিযোগ যুক্তিযুক্ত মনে হওয়ায় সেগুলোও আরওসি’কে পাঠানো হয়।’— লেখা হয়েছে চিঠিতে।
নিজেরা দায় ঝেড়ে দিল্লির কোর্টে এ ভাবে বল ঠেলে দেওয়ার পিছনে যুক্তিও খাড়া করা হয়েছে অর্থ দফতরের ওই নোটশিটে। বলা হয়েছে, অবৈধ লগ্নি সংস্থাকে বাগে আনার মতো কোনও আইন দফতরের হাতে ছিল না। তাই সরকার কিছু করেনি।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকার চাইলে তখন ফৌজদারি আইনেই ব্যবস্থা নিতে পারত। ‘‘বিধাননগর পুলিশ যখন সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে কাশ্মীর থেকে ধরে আনল, তখনও কি রাজ্যের হাতে তেমন কোনও বিশেষ আইন ছিল?’’— পাল্টা প্রশ্ন এক সিবিআই অফিসারের। এমতাবস্থায় ‘গা বাঁচানো’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষাপটটাই তাঁরা খুঁজে বার করতে চাইছেন। আর তার জল কত দূর গড়াবে, সেই জল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্য প্রশাসনের আনাচে-কানাচে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy