Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কেন্দ্রের বরাদ্দ ছাঁটাই, ভুগছে হোমের শিশুরা

বিতর্কের মূলে সেই কেন্দ্র-রাজ্য চিরন্তন প্রশাসনিক টানাপড়েন। যার ফল ভুগছে অসহায় কিছু ছেলে-মেয়ে। রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার সময়ে টাকা না-দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্য দিকে দিল্লির যুক্তি, আগের খরচের হিসেব-নিকেশ (কাজ শেষের শংসাপত্র, সংক্ষেপে ইউসি) না-পেলে পরের কিস্তি ছাড়া যায় না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৬
Share: Save:

বিতর্কের মূলে সেই কেন্দ্র-রাজ্য চিরন্তন প্রশাসনিক টানাপড়েন। যার ফল ভুগছে অসহায় কিছু ছেলে-মেয়ে।

রাজ্যের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার সময়ে টাকা না-দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্য দিকে দিল্লির যুক্তি, আগের খরচের হিসেব-নিকেশ (কাজ শেষের শংসাপত্র, সংক্ষেপে ইউসি) না-পেলে পরের কিস্তি ছাড়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইউসি দিতে দেরি করেছে বলেই পরের কিস্তির টাকা দেরিতে গিয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পে রাজ্যের দেয় অর্থ (ম্যাচিং গ্রান্ট)-ও দেরিতে জমা পড়ছে বলে অভিযোগ কেন্দ্রের। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা খরচ হয়নি— এই যুক্তিতে পরবর্তী বরাদ্দও তারা ছাঁটাই করেছে।

আর এই বিতণ্ডার জেরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হোমের আবাসিক শিশু-কিশোর-কিশোরীদের খাওয়া-পরা বন্ধ হওয়ার উপক্রম! কারণ, রাজ্যের ১৯টি সরকারি ও ৩৫টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোম এবং ২৪টি ‘ওপেন শেল্টারে’ আশ্রিত অনাথ বা সাজাপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ের খাওয়া-দাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচ-খরচা মেটানো হয় যে প্রকল্প থেকে, অর্থাভাবে সেই সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প (আইসিপিএস)-এর কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে।

সরকারি সূত্রের খবর: আইসিপিএসে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে ২২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্র। তার ২০ কোটি আসে অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার দিন দশেক আগে, যা খরচ করতে করতে ২০১৪-র জুলাই গড়িয়ে যায় বলে জানিয়েছেন রাজ্যের সমাজকল্যাণ-অধিকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। অন্য দিকে দিল্লির যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে বরাদ্দ টাকা খরচের ইউসি পাঠাতে দেরি করেছিল। তাই পরের বছরের টাকা গিয়েছে দেরি করে। দিল্লির দাবি, এ জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারই দায়ী।

আবার বিগত অর্থবর্ষের (২০১৪-১৫) জন্য আইসিপিএসে পশ্চিমবঙ্গ ৭১ কোটি টাকা চাইলেও কেন্দ্র বরাদ্দ করে ৪৫ কোটি। তার ৫ কোটি আগে এলেও ২০ কোটি টাকা এসেছে গত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে। পাশাপাশি দিল্লি জানিয়ে দিয়েছে, বাকি ২০ কোটি আর দেওয়াই হবে না। কেন? কেন্দ্রের যুক্তি, রাজ্য ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের টাকা সময়ে খরচ করতে না-পারার কারণেই বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শিশু নিরাপত্তা কমিটি (সিডব্লিউসি) এবং জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডও আইসিপিএসের আওতায়। কেন্দ্রীয় বরাদ্দে এ ভাবে টান পড়ায় তারাও অশনি সঙ্কেত দেখছে। ‘‘কেন্দ্র দেরি করে টাকা পাঠাবে, আবার বরাদ্দ থেকে টাকা কেটেও নেবে, এটা হতে পারে না।’’— ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া রাজ্যের সমাজকল্যাণ-সচিব রোশনী সেনের। তিনি বলেন, ‘‘এর প্রতিবাদে দিল্লিকে চিঠি দিয়েছি দিন কয়েক আগে। বলেছি, অন্তত হোমের বাচ্চাদের কথা মাথায় রেখে বাকি কুড়ি কোটি আগামী দু’মাসের মধ্যে পাঠিয়ে দিন।’’ সরকারি-সূত্রের খবর, সচিবের আবেদন বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের এক অধিকর্তা।

টাকা মিলবে কি না, তা সময়ই বলবে। কিন্তু তরজার জেরে এই মুহূর্তে ডামাডোল তুঙ্গে। চলতি অর্থবর্ষে (২০১৫-১৬) আইসিপিএসের কোনও বাজেট-পরিকল্পনাই করা হয়নি। ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, হোমের ছেলে-মেয়েরা ভাল ভাবে খেতে পাচ্ছে না, মাসের পর মাস দরকারি জিনিসপত্র পাচ্ছে না। সচিবও বলছেন, ‘‘সবচেয়ে খারাপ লাগছে বাচ্চাগুলোর জন্য। ওরা কী খাচ্ছে, কী পড়ছে— এ সব ভেবে খুবই চিন্তায় রয়েছি।’’

ওদের অবস্থাটা ঠিক কী রকম?

ঝাড়গ্রামে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত এক হোমের মুখপাত্র দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অপুষ্ট বাচ্চাদের নিউট্রিশন ড্রিঙ্ক দেওয়া যাচ্ছে না। মাংসের পাট তো উঠেই গেছে, সপ্তাহে দু’দিন ওরা মাছও ঠিকঠাক পাচ্ছে না।’’ ডেবরার এক সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমের তরফে ত্রিদিব দাস বেরা জানাচ্ছেন, ‘‘ঠিকাদারের হাতে-পায়ে ধরে আপাতত শুধু কুমড়ো-পটল দিয়ে চালাচ্ছি।’’ বহরমপুরের এক হোম কর্তৃপক্ষের আক্ষেপ, ‘‘রোজ সয়াবিন আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। টাকাই নেই, বাচ্চাদের ভাল খাবার দেব কী করে?’’

ধাক্কা খাচ্ছে সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও। সরকারি সূত্রের খবর, কেন্দ্রের টাকা সময়ে না-আসায় প্রস্তাবিত সাতটি বেসরকারি ও তিনটি সরকারি হোম চালু করা যায়নি। চারটি ‘স্পেশ্যাল অ্যাডপশন এজেন্সি’ খোলার উদ্যোগও শিকেয়। জেলা শিশু সুরক্ষা ইউনিট এবং সিডব্লিউসি’র শ’খানেক পদে লোক নিয়োগ হয়নি। বহু হোমে পরিকাঠামো সংস্কার থমকে রয়েছে।

এ হেন সঙ্কটের জন্য রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রকে দুষলেও একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে। সময় মেনে দিল্লিকে ইউসি পাঠানো হয় না কেন? দফতরের কর্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যাখ্যা মিলছে না। তাঁরা ঠারেঠোরে মেনে নিচ্ছেন, এই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ার আশা বিশেষ নেই। ইউসি’তে দেরির জের ধরে বরাদ্দ অর্থে যেমন নিয়মিত কোপ পড়বে, তেমন দুই সরকারে চাপান-উতোরেও বিরতি পড়বে না। আর তার আঁচ পুইয়েই যাবে হোমের বাচ্চারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE