Advertisement
E-Paper

আপাতত বন্ধ বিশ্বভারতী, পৌষমেলার মাঠ ঘেরায় চরম অশান্তি

পৌষমেলার মাঠকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরার চেষ্টা শুরু হতেই ক্ষোভ, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, আশ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে।

বাসুদেব ঘোষ ও সৌরভ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২০ ০৪:২৬
জনরোষ:  পে-লোডারে ভাঙা পড়ল পৌষমেলার মাঠের পাঁচিল। ঢালাই মেশিন উল্টে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল অস্থায়ী ক্যাম্প অফিসও। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

জনরোষ: পে-লোডারে ভাঙা পড়ল পৌষমেলার মাঠের পাঁচিল। ঢালাই মেশিন উল্টে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল অস্থায়ী ক্যাম্প অফিসও। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

পাঁচিল দিয়ে পৌষমেলার মাঠ ঘেরাকে কেন্দ্র করে শনিবার থেকে যে অশান্তির সূত্রপাত, সোমবার সেটাই জনরোষের চেহারা নিয়ে আছড়ে পড়ল শান্তিনিকেতনে। মিছিল হল, বিক্ষোভ হল, স্লোগান উঠল, অস্থায়ী ক্যাম্প অফিস ভেঙে ফেলা হল, পে-লোডার এনে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল মেলার মূল প্রবেশদ্বার, ছুড়ে ফেলা হল পাঁচিলের নির্মাণ সামগ্রী। হামলার জেরে আপাতত বিশ্বভারতী বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি।

পৌষমেলার মাঠকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরার চেষ্টা শুরু হতেই ক্ষোভ, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, আশ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ দিন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্যপাল আমাকে ফোন করার পরে আমি যতটা খোঁজ পেয়েছি, তাতে শুনেছি, পৌষমেলার মাঠের আশপাশে কিছু নির্মাণের কাজ চলছিল। সেখানে আরও কিছু বহিরাগত উপস্থিত ছিল, তাদের উপস্থিত থাকাও ঠিক ছিল না নির্মাণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ছাত্র এবং বোলপুরের মানুষ তা পছন্দ করেননি।’’ মুখ্যমন্ত্রী জানান, জেলাশাসককে এ বিষয়ে বৈঠক করতে বলেছেন। উপাচার্যের কী বক্তব্য তিনি বলুন। ছাত্রদের বক্তব্য তারা বলুক। সাধারণ মানুষের কয়েক জনকে ডাকা হোক। বুধবার সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসার কথা জানিয়েছেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। তবে পাঁচিল তোলা নিয়ে যাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সেই উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য এ দিন মেলেনি।

শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে কোনও রকম নির্মাণের যে তিনি বিরোধী, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায় ‘‘আমি চাই না, ওখানে কোনও নির্মাণ হোক। বিশ্বভারতী যখন বিশ্বকবি তৈরি করেছিলেন, তখন তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল, ফাঁকা জায়গায় প্রকৃতির পরিবেশে খোলা আলোয় প্রকৃতির কোলে গাছতলায় বসন্ত উৎসব থেকে পৌষমেলা সবই হবে।’’

এ সবের মধ্যেই রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপত্তায় যে চার জন সশস্ত্র পুলিশকর্মী দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ডিউটি ছেড়ে রবিবার পাঁচিল তোলার জায়গায় উপস্থিত থাকায় তাঁদের সিউড়িতে, জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজ় করে দেওয়া হয়েছে বলেও খবর।

পৌষমেলার মাঠ ঘেরার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পৌষমেলা বাঁচাও কমিটি’র নাম করে সোমবার জমায়েত ও ধিক্কার মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। এ দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বোলপুর দমকল অফিসের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলে দেখা যায় তৃণমূলের বিধায়ক তথা বোলপুরের বিদায়ী উপ-পুরপ্রধান নরেশ বাউরি, বিদায়ী কাউন্সিলর ওমর শেখ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। হাজার চারেক মানুষের মিছিলে ছিলেন বোলপুর শহর লাগোয়া বেশ কয়েকটি গ্রামের আদিবাসীরাও।

আরও পড়ুন: ‘গুঁড়িয়ে দাও’ বলেই শুরু ভাঙচুর, ধূলিসাৎ ক্যাম্প

জমায়েতের সামনে দাঁড় করানো একটি পে-লোডার। আর পিছন থেকে ক্রমাগত স্লোগান উঠেছে—‘মেলার মাঠকে ঘিরে দেওয়া পাঁচিল ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘উপাচার্য গো ব্যাক’, ‘রবীন্দ্র আদর্শ বিরোধী উপাচার্যকে জানাই ধিক্কার’ কিংবা ‘মেলার মাঠকে পাঁচিল দিয়ে জেলখানা বানানো চলছে না চলবে না’। মিছিল থেকেই নরেশবাবু প্রশ্ন তোলেন, ‘‘কেউ তো মেলার মাঠ দখল করতে চায়নি। তা হলে কেন মাঠ ঘেরা হচ্ছিল?’’

মিছিল শান্তিনিকেতন থানার কাছাকাছি আসতেই শুরু হয় তাণ্ডব। ফেলে দেওয়া হয় ঢালাই মেশিন, অস্থায়ী ক্যাম্প অফিসের চেয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়, পে লোডার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ভুবনডাঙ্গা বাঁধ সংলগ্ন মেলার মাঠের মূল প্রবেশদ্বার, যা গত কয়েক বছর তালাবন্ধই ছিল। মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায় নির্মাণের জন্য জড়ো করা ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট, ইলেকট্রিক বাল্ব, পাখা, হ্যালোজেন। যদিও বোলপুর ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সুনীল সিংহের দাবি, ‘‘যে সমস্ত নির্মাণ সামগ্রী ছিল, তা ঠিকাদারের কর্মীরাই নিয়ে গিয়েছেন।’’

গোটা ঘটনার সময় বিশ্বভারতীর কাউকে ধারেপাশে দেখা যায়নি। পরে বিশ্বভারতীর তরফে জরুরি বৈঠক ডাকা হয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখান থেকে বেরিয়ে সদ্য প্রাক্তন কর্মসমিতির সদস্য সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পুরো ঘটনার ছবি-সহ বিবরণ ও ক্ষয়ক্ষতির তালিকা স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষা মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছে। পরে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, গ্রিন বেঞ্চের নির্দেশ মেনেই পাঁচিল দেওয়া হচ্ছিল। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে দু’টি থানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। এসডিও-কে ১৪৪ ধারা জারি করার অনুরোধ করা হয়েছিল। তা-ও মানা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রককে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্মসমিতি।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন বলেছেন, ‘‘ভিসি-কে অনুরোধ করব, আপনারা না-ডাকলে পুলিশ বা ডিএম ভিতরে যেতে পারে না। শিক্ষাক্ষেত্রে না ডাকলে পুলিশ যায় না। তখনই পুলিশ যাবে যখন যাওয়া প্রয়োজন বলে মনে করবে।’’ বীরভূমের পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ বলেন, ‘‘প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে যে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, সেটা আমরা করেছি। ওই ঘটনায় আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ কর্মসমিতির আর এক সদস্য দুলালচন্দ্র ঘোষ জানান, নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত আপাতত ভর্তি প্রক্রিয়া ও জরুরি পরিষেবা বাদে বিশ্বভারতীর অন্য সব বন্ধ রাখার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে কর্মসমিতির বৈঠকে। এ কথা জানাজানি হতেই জনাকয়েক পড়ুয়া অবস্থান বিক্ষোভে বসেন উপাচার্যের বাসভবন ‘পূর্বিতা’র সামনে। তাঁদের অভিযোগ, এই সিদ্ধান্তে অন্তিম বর্ষের পড়ুয়া এবং যাঁরা এ বছর ভর্তি হবেন, তাঁরা ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়বেন।

Visva Bharati Pous Mela Protest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy