ভোটের মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাতায় যোগ হল আরও দু’লক্ষ চাকরি! প্রায় পাঁচ বছর ধরে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে তাঁর দাবির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি নবান্নের কর্তারা। এখন ৬৮ লক্ষ ছেলেমেয়েকে চাকরি দিয়েছেন বলে যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী করছেন, তা শুনে প্রশাসনের কর্তাদের চোখ ছানাবড়া! এখানেই শেষ নয়, নবান্নের কর্তাদের অবাক করে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ বার ঘোষণা করলেন, ‘‘আরও ২ লক্ষ ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।’’
মঙ্গলবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ‘উৎকর্ষ বাংলা’ নামে নতুন একটি প্রকল্পের সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে দাবি করেন, ‘‘সাড়ে চার বছরে ৬৮ লক্ষ যুবক-যুবতীর চাকরি হয়েছে। আরও ২ লক্ষ প্রার্থী সরকারি চাকরির পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।’’ ফলে সব মিলিয়ে তাঁর সরকার ৭০ লক্ষ বেকারের চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলেছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে তাঁর ঘোষণা, চার বছরে রাজ্যে ১৫ লক্ষ ছেলেমেয়ে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তার মধ্যে ১০ লক্ষেরই চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘শুধু প্রশিক্ষণ দিলে হবে না, চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই কাজই হচ্ছে।’’ আগামী পাঁচ বছরে আরও অন্তত ৩০ লক্ষ ছেলেমেয়ে এই প্রশিক্ষণ পাবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি চাকরির নয়া হিসেবে দেওয়ার পাশাপাশি মমতা এ দিন সমালোচকদেরও পরামর্শ দেন এক দফা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যাঁরা বলেন আমাদের সময়ে কিছুই হয়নি, তাঁদের বলছি, আপনারা ভুল, ভুল, ভুল। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা না ছড়িয়ে ইতিবাচক হোন।’’ তাতে সমালোচনা অবশ্য বন্ধ হচ্ছে না। প্রত্যাশিত ভাবেই রাজ্যের বিরোধী দলগুলি মমতার নয়া দাবিকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, ‘‘সাত দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ৬৭ লক্ষ চাকরি দিয়েছেন। সাত দিনে তিন লক্ষ বেড়ে গিয়েছে। এই হারে বাড়তে থাকলে অচিরেই বিশ্ব রেকর্ড করবেন।’’ কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এখন গরু হারানো দশা। তাই কী বলছেন তিনি নিজেই জানেন না। বিধানসভা ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে প্রলাপ বকছেন।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘হিসেব যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে, এক-এক জনের হাতে দু’তিনটে করে চাকরি। রাজনীতি আমরাও করি। মাঠেঘাটে ঘুরি। তা হলে এত লোক আমাদের কাছে চাকরির জন্য আসে কেন?’’
প্রশাসনের কর্তাদের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা সম্ভব না হলেও জোর ধন্দে পড়ে গিয়েছেন তাঁরা। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘এত দিন তবু উন্নয়ন নিয়ে দাবি শোনা যাচ্ছিল। এখন মুখ্যমন্ত্রীর প্রায় সব বক্তব্যে কর্মসংস্থানের দাবি ঢুকে পড়েছে।’’ কিন্তু সাড়ে চার বছরে সরকারি চাকরির এমন পরিসংখ্যান মুখ্যমন্ত্রী কোথা থেকে পেলেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না প্রশাসনের কর্তারা। তাঁদের একাংশের ধারণা, এর মধ্যে ১০০ দিনের কাজ, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রামে ‘আশা’ কর্মী নামে অস্থায়ী ভিত্তিতে যত নিয়োগ হয়েছে— সব ধরে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ওই দাবি করছেন। স্থায়ী সরকারি চাকরি বলতে যা বোঝায়, তা মুখ্যমন্ত্রীর দাবির ধারে-কাছেও নয়। বরং সরকারের বিভিন্ন দফতর, নিগম, বিভাগ ও অন্যান্য জায়গায় হাজার হাজার পদ শূন্য পড়ে রয়েছে। প্রশাসনের অন্য একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর দাবির মধ্যে একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজ রয়েছে। তা হলে সেটা তাঁর সরকারের দেওয়া চাকরি বা কর্মসংস্থান বলে মমতা দাবি করেন কী করে?
ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই মমতা দাবি করেছিলেন, প্রতিশ্রুতির ৯০% কাজ করে ফেলেছে তাঁর সরকার। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলায় তাঁর ঘোষণা, সরকারের আর কোনও কাজ করার নেই। কিছু করতে হলে নতুন করে ভাবতে হবে। বলেছেন, ‘‘চারশো বছরের কাজ চার বছরে করে ফেলেছি।’’ এতে অন্যান্য মন্ত্রী এবং প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা বারবার অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাঁদের অনেকের কথায়, মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি প্রমাণ করা খুব কঠিন। কেউ চাইলে ‘সব কাজ’ মানে কতটা, সেটাই স্পষ্ট নয়। রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়নে যে সব কাজ করেছেন বলে মমতা অহরহ যে দাবি করে চলেছেন, তারও সমালোচনা করেছেন একাধিক মুসলিম নেতা। রাজ্যে মুসলিমদের দুর্দশার ছবি ধরা পড়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতীচীর সাম্প্রতিক রিপোর্টে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও যা নিয়ে মুখ খুলেছেন।