Advertisement
E-Paper

খুশি ছিটমহল, মন খারাপ চর মেঘনার

মাথাভাঙায় স্নান করতে গেলে ও পার থেকে প্রায়ই ছিটকে আসছে প্রশ্নটা—‘কর্তা, আপনাগো তালে কি হইল গো?’ অস্বস্তি আর রাগ দুই-ই আছড়ে পড়ছে এ পারে। তড়িঘড়ি স্নান সেরে ভেজা কাপড়েই ঘরে ফিরছে চর মেঘনা।

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২২
চোখে জল চর মেঘনার মানুষের। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

চোখে জল চর মেঘনার মানুষের। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।

মাথাভাঙায় স্নান করতে গেলে ও পার থেকে প্রায়ই ছিটকে আসছে প্রশ্নটা—‘কর্তা, আপনাগো তালে কি হইল গো?’

অস্বস্তি আর রাগ দুই-ই আছড়ে পড়ছে এ পারে। তড়িঘড়ি স্নান সেরে ভেজা কাপড়েই ঘরে ফিরছে চর মেঘনা।

উত্তরবঙ্গে ছিটমহলগুলি যখন সীমানা ভেঙে এক হয়ে গিয়ে উৎসবের মেজাজে তখন নিজের দেশে পরবাসী হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে নদিয়া সীমান্তে কাঁটাতারের ওপারের ভারতীয় গ্রাম, চর মেঘনা। যে গ্রামের সরকারি খাতায় ‘স্টেটাস’—‘এপিএল বা অ্যাডভার্স পজেশন ল্যান্ড’।

অন্যান্য বছর ৩১ জুলাই থেকেই গ্রামে শুরু হয়ে যায় ১৫ অগস্টের প্রস্তুতি। গেরুয়া-সাদা-সবুজ কাগজ কেনা, গদ জোগাড় করা, খেলার মাঠ পরিষ্কার রাখা, পতাকা ঠিক করে রাখার মতো হাজারো ব্যস্ততায় মেতে উঠত সীমান্তের এই গ্রাম। কিন্তু এ বার স্বাধীনতা দিবসের আগে সেই ব্যস্ততা বিলকুল হাওয়া। কেন?

গ্রামের বাসিন্দা তথা হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সিপিএমের বুদ্ধদেব মণ্ডল বলছেন, ‘‘মন ভাল নেই গো দাদা। সবসময় মনে হচ্ছে, স্বাধীন দেশে থেকেও আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? মাথাভাঙায় স্নান করতে গেলেই ও পারের লোকজন খোঁজ খবর নিচ্ছে আমাদের কী হবে? অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে রাগও হচ্ছে।’’

ফাল্গুনী মাহাতোর কথাই ধরা যাক। আর পাঁচটা দিন টিভির সামনে থেকে নড়তেই চান না তিনি। পড়শিদের ভিড়ে প্রতি সন্ধ্যায় সরগরম হয়ে ওঠে তাঁর বাড়ির একচিলতে বারান্দা। কিন্তু আজ দু’দিন থেকে বোকা বাক্স একেবারে বোবা। পড়শিরা বাড়িতে আসছেন ঠিকই। কিন্তু সকলেই মনমরা। ফাল্গুনীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘টিভি খুললেই ছিটমহলের বাসিন্দাদের উচ্ছ্বাসের খবর, আনন্দের খবর। আর হবে নাই বা কেন, এত বছর পরে মুক্তির স্বাদ পাচ্ছেন ওঁরা। কিন্তু আমাদের কী হবে? আর কতদিন আমাদের কাঁটাতারের বাইরে থাকতে হবে!’’

চর মেঘনার এই অভিমান যে মোটেই অস্বাভাবিক নয় তা মানছেন প্রশাসনের কর্তারাও। করিমপুর ১ বিডিও তাপস মুখোপাধ্যায় জানান, ভৌগোলিক ভাবে চর মেঘনার কিছু অসুবিধা তো রয়েইছে। চর মেঘনা অ্যাডভার্স পজেশন ল্যান্ড। জমি বাংলাদেশের। বাস করেন ভারতীয়রা। সেই কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা জমিতে ফসল ফলালেও জমি বিক্রি করতে পারেন না। ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘরও ওঁরা পান না। ভুল করে কয়েকজন পেয়ে গিয়েছেন। তাঁদের বলা হয়েছে টাকা ফেরত দিতে। আবার মাথাভাঙার ও পারে জামালপুর ভারতীয় জমি। সেখানে বসবাস করেন বাংলাদেশের লোকজন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘চর মেঘনা যেহেতু অ্যাডভার্স ল্যান্ড। তাই উত্তরের ছিটমহলের মতো এই গ্রামে কিছু হচ্ছে না। জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, ‘‘চর মেঘনার সমস্যার কথা শুনেছি। কিন্তু ওই গ্রামের ব্যাপারে এখনও আমাদের কাছে কোনও নির্দেশ আসেনি।’’

হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই গ্রাম কাঁটাতারের বেড়ার ও পারে। গ্রাম শেষ হলেই মাথাভাঙা। তারপর বাংলাদেশ। গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল আর বিএসএফের ক্যাম্প বাদ দিলে নেই—এর তালিকা বেশ দীর্ঘ। বাজার-হাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল সবই রয়েছে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে। ফলে নিজের দেশে ঢুকতে বেরোতে ভরসা ভোটার কার্ড। গ্রামে সবকিছুই চলে বিএসএফের মর্জি মাফিক।

করিমপুরের বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলছেন, ‘‘চর মেঘনার বিষয়টি আমি ফের বিধানসভায় জানাব।’’ গ্রামের ৮৫ বছরের নগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলছেন, ‘‘আমরা তো বেশি কিছু চাইছি না। জমি সমস্যার সমাধান করে আমাদের গ্রামকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোক। গ্রামকে কাঁটাতারের বাইরে না রেখে গ্রামের বাইরে দিয়েই কাঁটাতারের ব্যবস্থা করে দিলেই আমরা খুশি।’’

শান্তিপুরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন চর মেঘনার অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। ৩১ জুলাই ছিটমহলের মতো কিছু একটা হবে বলে তিনিও ছুটে এসেছিলেন গ্রামে। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভেবেছিলাম ১৫ অগস্টের আগেই আর একটা স্বাধীনতা দিবস পালন করব। কিন্তু আনন্দ নয়, গ্রামের সবার সঙ্গে যন্ত্রণাটাই ভাগ করে নিচ্ছি!’’

gaurab biswas chitmahal chor meghna india bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy