Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বহরমপুর কলেজ

অনলাইনের নির্বাসনে ভর্তি ঘিরে ধুন্ধুমার

সিঁদুরে মেঘ দেখে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। আর সেটাই সত্যি হতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু না-হওয়ায় কলেজে কলেজে দাদাগিরি আর ছাত্র-সংঘর্ষের ভয় পাচ্ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা। বৃহস্পতিবার সেটাই ঘটেছে বহরমপুর কলেজে। ভর্তির কাউন্সেলিং নিয়ে ছাত্র পরিষদ এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বহরমপুরের ওই কলেজ চত্বর।

পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌঁড়তে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এক অভিভাবিকা। বৃহস্পতিবার। ছবি:  গৌতম প্রামাণিক।

পুলিশের তাড়া খেয়ে দৌঁড়তে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এক অভিভাবিকা। বৃহস্পতিবার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বহরমপুর ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৪ ০৩:৩৫
Share: Save:

সিঁদুরে মেঘ দেখে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেকে। আর সেটাই সত্যি হতে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু না-হওয়ায় কলেজে কলেজে দাদাগিরি আর ছাত্র-সংঘর্ষের ভয় পাচ্ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা। বৃহস্পতিবার সেটাই ঘটেছে বহরমপুর কলেজে। ভর্তির কাউন্সেলিং নিয়ে ছাত্র পরিষদ এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় বহরমপুরের ওই কলেজ চত্বর। বচসা থেকে হাতাহাতি। বোতল ছোড়াছুড়ি। বেধড়ক লাঠি পুলিশের। হুড়মুড় করে পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আহত হন কাউন্সেলিংয়ে আসা বেশ কয়েক জন ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক। লাঠির ঘায়ে আহত ছাত্র পরিষদের দুই এবং টিএমসিপি-র দুই সদস্যকে ভর্তি করানো হয় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরে দু’জনকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়।

শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন স্নাতক স্তরে ভর্তিতে কেন্দ্রীয় অনলাইনের বন্দোবস্ত করার কথা জানিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হয়েই ওই ব্যবস্থা তুলে দেন। তার পরে ফর্ম বিলিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি কলেজে ছাত্র-সংঘর্ষ হয়। কাউন্সেলিংয়ে যে ফের গোলমাল হতে পারে, তখনই সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেক কলেজ-অধ্যক্ষ। বহরমপুর কলেজে হাঙ্গামার পরেও পার্থবাবু কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল। তিনি ফের জানিয়ে দিয়েছেন, “কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তি বা কাউন্সেলিং কোনও দিনই হবে না।”

অথচ কলকাতার একাধিক কলেজের অধ্যক্ষদের মতো বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডলও মনে করেন, “কেন্দ্রীয় অনলাইনে ভর্তির ব্যবস্থা থাকলে এই গোলমাল এড়ানো যেত।” শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁর মন্তব্য, “অনলাইন বন্ধের জন্য গোলমাল হয়নি। গোলমাল পাকানোর ইচ্ছা থাকলে অন্য ভাবেও করা যায়।” তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, বহরমপুরের ঘটনার দায় তাঁর উপরে বর্তাবে না কেন? মন্ত্রীর জবাব, “গোলমালের দায় আমার উপরে বর্তায় কি না, ছাত্রসমাজ ঠিক করবে। মানুষ তার বিচার করবেন। কারণ, আমরা মানুষের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে এসেছি। সংবাদপত্রের দ্বারা নয়।”

একই সঙ্গে পার্থবাবু জানান, তিনি দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন না। এ দিন ওই হাঙ্গামার কথা শোনার পরেই তিনি বহরমপুরের কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব জানতে চান। কী ভাবে মেধা-তালিকা ছাত্র সংসদের হাতে গেল, জানতে চেয়েছেন তা-ও। উচ্চশিক্ষা সচিব বিবেক কুমার ফোন করেন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসককে। শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, টিএমসিপি ওই কলেজে অবস্থানে বসলেও দ্রুত তা তুলে নেওয়ার জন্য টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাকে ফোনে নির্দেশ দেন তিনি। আধ ঘণ্টার মধ্যে টিএমসিপি অবস্থান তুলে নেয়। “কলেজের প্রশাসনিক বিষয় দেখার দায়িত্ব অধ্যক্ষের। তাঁকে সেটা সামলাতে বলেছি। বলেছি, মেধা-তালিকা দ্রুত কলেজের নোটিস বোর্ডে টাঙিয়ে দিতে হবে,” বলেছেন মন্ত্রী।

আর কী বলছেন অধ্যক্ষ?

অধ্যক্ষ জানান, কাউন্সেলিংয়ের শুরুতেই একটি রাজনৈতিক দলের পাঁচ-সাত জন বহিরাগত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। তাদের চিহ্নিত করে কলেজ থেকে বার করে দিতে বলা হয় পুলিশকে। “কিন্তু পুলিশ আমল দেয়নি। পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় কলেজের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে,” অভিযোগ অধ্যক্ষের।

সংঘর্ষের পরে কলেজ-কর্তৃপক্ষ সাময়িক ভাবে কাউন্সেলিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে জটিলতা কেটে যায় জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, “সাধারণ পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখেই প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছিলাম। অধ্যক্ষও ছিলেন। সূচি মেনেই কাউন্সেলিং হবে।”

ঠিক কী ঘটেছিল ওই কলেজে?

এ দিন ছিল বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও ভূগোল (কলা ও বিজ্ঞান) অনার্সের কাউন্সেলিং। ছাত্রছাত্রীরা সকাল থেকেই অভিভাবকদের নিয়ে কলেজে হাজির হন। কাউন্সেলিংয়ে ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন কলেজ-কর্তৃপক্ষ। কলেজের ছাত্র সংসদ দখলে থাকার সুবাদে ছাত্র পরিষদের শ্রেণি-প্রতিনিধি বেশি। টিএমসিপি তা মানতে পারেনি বলে অভিযোগ। তারা দাবি তোলে, তাদেরও ছাত্র পরিষদের সমসংখ্যক প্রতিনিধি রাখতে দিতে হবে। প্রতিবাদ করে ছাত্র পরিষদ। শুরু হয় বচসা।

কাউন্সেলিংয়ে দেরি হতে থাকায় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে অভিভাবকদের। কাউন্সেলিং কক্ষের মাইক টেনে নিয়ে এক অভিভাবিকা ছাত্র সংগঠনের উদ্দেশে কিছু বলতে গেলে তাঁর মাইক্রোফোন কেড়ে নেন জেলা ছাত্র পরিষদের সভাপতি সরফরাজ শেখ রুবেল। টিএমসিপি-র দিক থেকে জলের বোতল ছোড়া হয় রুবেলের উদ্দেশে। শুরু হয় মারামারি। অধ্যক্ষের নির্দেশে দু’পক্ষের বহিরাগতদের হটাতে লাঠি চালায় পুলিশ ও কমব্যাট ফোর্স। নিরীহ ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকেরাও বাদ যাননি। লাঠির ঘায়ে জখম এক ছাত্রী পড়ে গিয়ে কাতরাতে থাকেন। লাঠি থেকে বাঁচতে গেট দিয়ে পালাতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যান কিছু ছাত্রী। তাঁদের মাড়িয়ে পালাতে থাকেন।

কাউন্সেলিং বন্ধ হয়ে যায়। টিচার্স কাউন্সিলের বৈঠক ডাকতে বাধ্য হন অধ্যক্ষ। বৈঠক চলাকালীন অধ্যক্ষকে ফোন করেন পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর। তখন অধ্যক্ষের সামনে ছিলেন বহরমপুর থানার আইসি অরুণাভ দাস ও ডেপুটি পুলিশ সুপার (সদর) ইসমাতারা জাহান। অধ্যক্ষ তাঁদের সামনেই এসপি-র কাছে বহরমপুর থানার বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করেন। অধ্যক্ষের অভিযোগ মানতে চায়নি পুলিশ। তাদের বক্তব্য, পুলিশ ঠিক সময়ে ব্যবস্থা না-নিলে ঘটনা অন্য দিকে গড়াতে পারত। বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। তিনি বিধানসভায় বলেন, ওই কলেজে ছাত্র পরিষদের উপরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হামলা করেছে। পুলিশি সন্ত্রাসও চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE