Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

স্টেশনের বাচ্চারা জানে, গীতাদিই তাদের বাতিঘর

লম্বা-রোগা তরুণী চোয়াল শক্ত করে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তাঁর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বছর চোদ্দোর এক কিশোর। ‘‘আমি আবার এক টিউব ডেনড্রাইট নিয়ে ফেলেছি দিদি। তোমার থেকে লুকবো না। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওরা সবাই জোরাজুরি করল। আর কোনও দিন হবে না।’’

গীতার সংস্থায় খেলায় মত্ত প্ল্যাটফর্মের খুদেরা। ইনসেটে, গীতা রাউত। দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

গীতার সংস্থায় খেলায় মত্ত প্ল্যাটফর্মের খুদেরা। ইনসেটে, গীতা রাউত। দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:১২
Share: Save:

লম্বা-রোগা তরুণী চোয়াল শক্ত করে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তাঁর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বছর চোদ্দোর এক কিশোর। ‘‘আমি আবার এক টিউব ডেনড্রাইট নিয়ে ফেলেছি দিদি। তোমার থেকে লুকবো না। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওরা সবাই জোরাজুরি করল। আর কোনও দিন হবে না।’’

তরুণীর মুখের রেখা নরম হল। কিশোরকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘দুর্বল হোস না। এখন লড়াইটা করতে না পারলে কোনও দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবি না।’’

অর্থ নেই, লোকবল নেই, উঁচু পর্যায়ের যোগাযোগ বা লোক ধরাও নেই। মনের জোর আর ছুটে বেড়ানোর ক্ষমতাই সম্বল। বড় কঠিন দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন বছর বত্রিশের গীতা রাউত। হাওড়া স্টেশন চত্বরের মোনু-আসাদ-গুলাবি-পায়েল-ইমরান-রোহিতদের (নাম পরিবর্তিত) জীবনের বাতিঘর এখন তাঁদের এই ‘দিদি’।

কোন বাচ্চা একা-একা ট্রেনে চেপে চলে এসেছে, কে জ্বরের ঘোরে ধুঁকছে, কার খাওয়া জোটেনি— গীতাদি ছুটছেন। ফেলে দেওয়া বোতল কুড়োতে গিয়ে কোন শিশু পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে, কাকে জিআরপি মারধর করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে— গীতাদি যাচ্ছেন লড়াই করে সেই বাচ্চাকে উদ্ধার করে আনতে। ডেনড্রাইট বা হোয়াইটনারের নেশায় কোন বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কে যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে— গীতাদি দৌড়চ্ছেন তাকে বাঁচাতে।

বিরাট পড়াশোনা নেই তরুণীর। নেই সোশ্যাল ওয়ার্কের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি কিম্বা শক্তিশালী পারিবারিক অবলম্বন। কিন্তু রিষড়ার স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই কী ভাবে যেন বাচ্চাদের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। একটু বড় হওয়ার পর প্ল্যাটফর্ম চত্বরের বাচ্চাদের নিয়ে লড়াই শুরু। উত্তরপাড়া থেকে লোকাল ট্রেনে আসা-যাওয়ার পথে রোজ দেখতেন এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো উলুঝুলু বাচ্চাগুলোকে। বলছিলেন, ‘‘ফুটফুটে, সম্ভাবনাময় কত মুখ দেখতাম। পাচার হয়ে যাওয়া, অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া, দিনের পর দিন শারীরিক অত্যাচার বা যৌন হেনস্থার শিকার হওয়া, চোদ্দো-পনেরো বছরে প্ল্যাটফর্মে সন্তানের জন্ম দেওয়া নিত্যকার ঘটনা বাচ্চাগুলোর জীবনে— সহ্য হচ্ছিল না!’’

হাও়ড়া স্টেশনে পুরনো প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিকে গঙ্গার ধার ঘেঁষে একটা ভাতের হোটেল। তারই ছাদের ঘরে জায়গা দিয়েছিলেন জনৈক কিশোর জায়সবাল। ঠিক দশ মাস আগে সেখানে রেজিস্ট্রেশন করেই ‘টিয়ার্স’ নামে একটি সংগঠন খুলে ফেললেন গীতা। সঙ্গে এক রিহ্যাব বিশেষজ্ঞ এবং এক কাউন্সেলর। ছাদের সেই ঘর প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধে পর্যন্ত স্টেশন চত্বরের বাচ্চাদের জন্য খোলা। তারা সেখানে পড়াশোনা করে, খায়-ঘুমোয়, শৌচাগার ব্যবহার করে। চলে কাউন্সেলিংও। রাত থেকে সকালের মধ্যে কারও কোনও বিপদ হলে বলা আছে গীতাদি-কে ফোন করার কথা। কত বার যে রাতবিরেতে ছুটে আসতে হয়েছে তাঁকে।

এই তো কিছু দিন আগে, গভীর রাতে বছর বারোর একটা মেয়ে কোনও এক দোকানদারের মোবাইল থেকে তাঁকে ফোন করেছিল। ‘‘দিদি আপ আ জাইয়ে অভি। নেহি তো ম্যায় মর জাউঙ্গি!’’ পরিচিত এক ট্যাক্সিচালকের ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন গীতা। মেয়েটি জানিয়েছিল, কয়েক সপ্তাহ ধরে এক বয়স্ক ভ্যানওয়ালা রাতে তাকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে। তার খুব ব্যথা লাগছে। থানা-পুলিশ-আদালত পর্যন্ত গিয়ে সেই ভ্যানওয়ালাকে জেলে ঢুকিয়েছেন গীতা। মেয়েটি এখন ভাল আছে বারুইপুরের এক হোমে।

গীতার গলা জড়িয়ে খুনসুটি করছিল বছর তেরোর আসাদ। নিজেই জানাল, বাড়ি ছিল গুয়াহাটিতে। বাবা শুধু নেশা করে মা-কে মারতেন। ছোট্ট ছেলের অভিযোগ, এক দিন গলায় ফাঁস পরিয়ে তার চোখের সামনেই মা-কে মেরে ফেললেন। শেষকৃত্য হওয়ার পর সেই রকম ফাঁসই আসাদ পরিয়ে দিয়েছিল বাবা-র গলায়। তার পর বাবা নেতিয়ে পড়ছে দেখেই বাড়ি থেকে ছুট। ট্রেন ধরে হাওড়া। সারাদিন সেখানে বোতল কুড়িয়ে ১০-২০ টাকা পাওয়া। তার পর বিকেল থেকে ডেনড্রাইট শুঁকে অচেতন হয়ে থাকা। আসাদকে উদ্ধার করে প্রথমে রিহ্যাবে রেখেছিলেন গীতা। কিন্তু সে তার দিদি-র কাছেই ফিরে এসেছে।

মাখলার পায়েল, বালি-র শুভজিৎ বা রোহিতকে কোনও দিন স্কুলে পাঠাননি বাবা-মা। প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষা করিয়েছেন, চুরি করিয়েছেন। নিজেরা নেশা করেছেন, বাচ্চাদেরও ধরিয়েছেন। টাকা না-আনলে জুটেছে মার। বাবা-মাকে বুঝিয়ে ওই বাচ্চাদের নিজের সংগঠনে নিয়ে এসেছেন গীতা। তাদের মাধ্যমেই খোঁজ পেয়েছেন আরও বাচ্চাদের।

কিন্তু গীতা জানেন, রাতের আশ্রয় যত দিন না দিতে পারবেন কাজ হবে না। মনোবিশেষজ্ঞদেরও একই মত। কারণ এখানে বাচ্চারা ভাল পরিবেশে থাকলেও রাতে তাদের সেই অন্ধকার দুনিয়াতেই ফিরতে হচ্ছে। ফলে গীতার দরকার একটু সরকারি সাহায্য। একটু অর্থ, একটু জায়গা আর লোকবল।

পথভোলা শৈশবের কাটা ঘুড়িতে সুতোটা পরিয়ে দিয়েছেন। এখন আরও কয়েকটা বাড়ানো হাত পেলেই তাকে খোলা আকাশে ওড়াতে পারবেন গীতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE