E-Paper

বঙ্কিমের আবেগ সত্য, তেমন সত্য রবীন্দ্রনাথের বিবেচনাও

ধর্ম ও সমাজ ভাবনায় দেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ। হিন্দু কল্পনায় দেশ মাতৃতুল্য। আর সেই সময়ে দেশমাতার কল্পনাকে যিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার শব্দবিন্যাসের মিশেলে আশ্চর্য এক গানে রূপ দিচ্ছেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

বিশ্বজিৎ রায় (বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক)

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৩
‘বন্দে মাতরম্’ রচনার ১৫০ বছর উদ্‌যাপন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে।

‘বন্দে মাতরম্’ রচনার ১৫০ বছর উদ্‌যাপন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। ছবি: সুমন বল্লভ।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ। মহাবিদ্রোহের পর ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রানির হাতে। ইংরেজ আমলে অন্যান্য ভারতীয়দের থেকে তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে থাকা বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকরা বুঝতে পারলেন রানির প্রজা হলেও তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নিচু শ্রেণির মানুষ। দেশকে ঘিরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আবেগ ক্রমে তাঁদের মনে তীব্র হয়ে উঠল। বাঙালিদের মধ্যে তখন এক দিকে ব্রাহ্মরা ভাঙতে ভাঙতে এগোচ্ছেন, অন্য দিকে হিন্দু ভদ্রলোকেরা যুক্তি ও কল্পনা দিয়ে তাঁদের ধর্ম ও সমাজ শোধন করতে চাইছে। বাংলায় এবং গোটা ভারতে— মুসলমানরা তখন কিছুটা আলোর বৃত্তের বাইরে।

ধর্ম ও সমাজ ভাবনায় দেশ অবিচ্ছেদ্য অংশ। হিন্দু কল্পনায় দেশ মাতৃতুল্য। আর সেই সময়ে দেশমাতার কল্পনাকে যিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার শব্দবিন্যাসের মিশেলে আশ্চর্য এক গানে রূপ দিচ্ছেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই কল্পনা তাঁর মনে নানা সময় দেখা দিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র কমলাকান্ত জন্মভূমি বঙ্গভূমিকে দেবী রূপে কল্পনা করেছে। এই ভাবনা বন্দে মাতরম্ গীতিতে প্রকাশ পেল (১৮৭৫ সালে)। বন্দে মাতরম্ গানটি আলাদা করে লেখা, পরে তা আনন্দমঠ উপন্যাসের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হল। সেই উপন্যাসে সন্তানদলের কর্মীরা আবেগদীপ্ত কণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন। এই গানে তাঁদের উদ্দীপনা জাগ্রত হত। অতীতে দেশমাতা যা ছিলেন সেই সমৃদ্ধির কথা ভেবে তাঁরা বিষণ্ণ হতেন। কারণ বর্তমানে, এখন মা তো রিক্ত, পরাধীন। উনিশ শতকেই বন্দেমাতরম্ হয়ে ওঠে দেশের গান, দেশের জন্য কাজ করার গান। ১৮৯৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ এই গান গেয়েছিলেন।

বিশ শতকের গোড়া থেকেই গানটিকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হল। গানটি আনন্দমঠ উপন্যাসের অংশ হওয়ায় ও আনন্দমঠে সন্তানদল বনাম মুসলমানদের দ্বন্দ্বের কথা থাকায় এই বিতর্ক হয়তো অনিবার্য ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশের কথা ভেবে অনেক গান লিখলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরেই এক দিকে যেমন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন মাথা তুলল, যুগান্তর দলের কাজকর্মে আন্দোলিত হল বঙ্গদেশ তেমনই মুসলিম লিগের জন্ম হল। লিগের রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিন্দু মহাসভা আরও দেড়-দুই দশক পরে প্রবল হয়ে উঠল। বিশ শতকে এই যে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক ও সামাজিক দূরত্ব বড় হয়ে উঠল তা রবীন্দ্রনাথের মনে গভীর চিন্তার জন্ম দিয়েছিল।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার অবধি ছিল না কিন্তু বন্দেমাতরম্ ধ্বনি ও এই গান যে হিন্দু মুসলমান বিভেদের সৃষ্টি করতে পারে তা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করলেন। তাঁর ঘরে-বাইরে উপন্যাসে জমিদার নিখিলেশের সঙ্গে বিপ্লবী সন্দীপের বন্দেমাতরম্ মন্ত্র নিয়ে তর্ক হয়। নিখিলেশ জানায় দেশের নামে কোনও এক মন্ত্রে মন ভোলাতে সে চায় না। সে চায় দেশের মানুষকে জানতে। পরে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের এই গানটির একটি অংশই রাজনৈতিক ভাবে গাইবার পক্ষে মত দিলেন— সুভাষচন্দ্র বসু ও জওহরলাল নেহরুকে সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন তিনি।

বঙ্কিমের প্রয়াণের পর মর্মাহত রবীন্দ্রনাথ এই কর্মযোগীকে হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে স্মরণ করেছিলেন। তার অর্থ কিন্তু এই নয় বঙ্কিমের গান যদি দেশের হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পথে সঙ্কট তৈরি করে তা হলে রবীন্দ্রনাথ নীরব থাকবেন! থাকেননি তিনি— এ গানের যে অংশ দেশেরই এক অংশকে আহত করতে পারে বলে মনে হয়েছিল তাঁর, সেই অংশটি তিনি বাদ দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ও জওহরলাল রবীন্দ্রনাথের সেই পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। ‘তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ এই জাতীয় পঙ্‌ক্তি যে চাইলে কেউ মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের কাজে লাগাতে পারেন এবং অপৌত্তলিকরা যে আহত হতে পারেন, তা মানতেন রবীন্দ্রনাথ।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। তার সঙ্গে দেশ ভেঙেও গিয়েছে। ভাঙা স্বাধীন এই দেশে ইতিহাসকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির চল ক্রমশ বেড়েছে। বন্দে মাতরম্ গানটি নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে, গত কয়েক বছরে তা তীব্র হয়েছে। দেশের জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের গঠনমূলক আবেগ যেমন সত্য, তেমনই বিশ শতকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের সতর্ক বিবেচনাও যে অত্যন্ত জরুরি, সে কথা মনে না রেখে বন্দে মাতরম্ গানটিকে সমানেই হিন্দুত্ববাদীরা রাজনীতির অস্ত্র করে তুলেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bankim Chandra Chattopadhyay Rabindranath Tagore Vande Mataram

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy