এক দিকে দুর্বল আর্থিক স্বাস্থ্য, অন্য দিকে বিপুল খরচের হাতছানি— আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে বুধবার পেশ হতে চলা রাজ্যের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে (২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের জন্য) এই দু’য়ের ভারসাম্য রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ নবান্নের। অভিজ্ঞ আধিকারিকদের একাংশের দাবি, নিজস্ব আয় তেমন বাড়ছে না রাজ্যের। কিন্তু ভোটমুখী অনুদান প্রকল্পের বিপুল খরচও সামলাতে হচ্ছে। ভোট-বছরের আগে এই বাজেটে সেই পথ বদলের সম্ভাবনা বেশ কম। এর সঙ্গে রয়েছে পরিকাঠামো-সহ একাধিক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বরাদ্দের দায়িত্ব। শেষ পর্যন্ত অবস্থান একই থাকলে রাজ্যের কোষাগারের পরিস্থিতি কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, কৌতূহল রয়েছে তা নিয়েই। যদিও আধিকারিকদের অন্য একটি অংশের মতে, সামাজিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং অনুদান-প্রকল্পের সুফল আসছে অর্থনীতিতে। তবে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বিপুল বকেয়া না থাকলে পরিস্থিতি আরও অনুকূল হত।
চলতি বছরই দেশের বড় ১৮টি রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যের (ফিসকাল হেলথ ইনডেক্স) সমীক্ষা প্রকাশ করেছে নীতি আয়োগ। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের নিরিখে হওয়া ওই সমীক্ষায় অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্রমতালিকার শীর্ষে রয়েছে ওড়িশা। সেই তালিকায় এ রাজ্যের অবস্থান ষোড়শ। পশ্চিমবঙ্গের পরে রয়েছে শুধুমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশ এবং পঞ্জাব। দীর্ঘকালীন আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে রাজস্বের অংশ খরচ, কেন্দ্রীয় অর্থের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি করে রাজ্যের নিজস্ব খরচ সামলানো, আর্থিক দূরদর্শিতা বা রাজস্ব ও রাজকোষ ঘাটতিতে নিয়ন্ত্রণে রাখা, রাজস্বের কতটা ঋণ পরিশোধে ব্যয় বা নতুন ধারের বোঝা চাপছে কি না এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গড় উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সুদ পরিশোধের হারের ইতিবাচক ব্যবধান থাকছে কি না, তা দেখা—এই পাঁচটি মানদণ্ডের উপর এই সমীক্ষাটি করেছিল নীতি আয়োগ। সব ক’টি ক্ষেত্রেই এ রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে দ্রুত এবং মানানসই পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের অনেকে।
প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, “কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া প্রায় ১ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা। একাধিক প্রকল্পের বরাদ্দ বন্ধ রেখেছে কেন্দ্র। ফলে রাজ্যকেই পুরো দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।”
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন এই সমীক্ষা হয়েছিল, তখন লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো বড় অনুদান প্রকল্পে মাসিক মাথাপিছু ভাতা ছিল ৫০০ এবং ১০০০ টাকা। আবাস প্রকল্পের বাড়তি বোঝা নিতে হয়নি রাজ্যকে। লোকসভা ভোটের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মাথাপিছু সেই অনুদান বেড়ে হয় ১০০০ এবং ১২০০ টাকা। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, তাতে মাসে কমবেশি ২৩০০ কোটি এবং বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। গত ডিসেম্বর থেকে ১২ লক্ষ উপভোক্তাকে আবাসের টাকা দেওয়া হচ্ছে। বিধানসভা ভোটের আগে তা দেওয়া হবে আরও ১৬ লক্ষ উপভোক্তাকে। এ ছাড়াও রয়েছে অনেকগুলি কর্মসূচি। সেগুলির পরিধিও বাড়ছে। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আসন্ন পূর্ণাঙ্গ বাজেটেও এগুলির প্রতিফলন থাকবে। বাজেট বরাদ্দে বিশেষ জোর থাকতে পারে লক্ষ্মীর ভান্ডার এবং আবাস প্রকল্পের উপর। গত বাজেটের মতো আসন্ন বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ডিএ ঘোষণা হয় কি না, আগ্রহ রয়েছে তা নিয়েও।
রাজ্যের সদ্য শেষ হওয়া বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলনে সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলির কথা যেমন তুলে ধরা হয়, তেমনই ছিল পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়ার বার্তা। তবে অনুদান প্রকল্পগুলির বিপুল ব্যয় সামলে পরিকাঠামো খাতে কী ভাবে বাড়তি বরাদ্দ আসবে, সেই চর্চা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। সংশ্লিষ্টরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত (২০২৩-২৪) বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় চলতি বছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি ৩,৬৯৯ কোটি টাকা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে রাজকোষ ঘাটতিও বাড়তে পারে প্রায় ন’হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ বছরের সংশোধিত হিসাবে ধার শোধের পরিমাণ ছিল ৭২,৯০৬ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ বছরে তা ৭৬,৬৯৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বেতন-পেনশন, দৈনন্দিন খরচ, দফতরগুলিকে বরাদ্দ দেওয়ার কাজ। অর্থ-কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, এ বছর প্রায় ১.০২ লক্ষ কোটি টাকা নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। কর-সহ কেন্দ্রীয় ভাগের বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯১,৯০০ কোটি টাকা। এত কিছুর পরে ঋণ নিয়ন্ত্রণে রেখে রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতিতে কতটা রাশ টানা যাবে, বিশ্লেষকদের নজর রয়েছে সে দিকে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)