Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
IACS

হিন্দিতে চিঠির জবাব দিতে হবে হিন্দিতেই, বিতর্ক কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফরমানে

কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ ১৯ মার্চ জারি হয়েছে এই বিজ্ঞপ্তি। সইসাবুদও হিন্দিতেই করা বাধ্যতামূলক।

গ্রাফিক: নিরুপম পাল।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২১ ১৮:৫৮
Share: Save:

দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মতো এ বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও কি ‘হিন্দি আগ্রাসন’ শুরু হল? সম্প্রতি এ প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যের শিক্ষক-পড়ুয়া বা নেটমাধ্যমের একাংশের মধ্যে। কলকাতার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দি ভাষা সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তি ঘিরে এই প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এই বিতর্ককে গুরুত্ব দিতে নারাজ ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। একে রুটিনমাফিক বিজ্ঞপ্তি বলেই আখ্যা দিয়েছেন তাঁরা।

কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আইএসিএস)-এ একটি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে এই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ১৯ মার্চে জারি করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের সমস্ত চিঠিপত্রের ৫৫ শতাংশই হিন্দিতে লিখতে হবে। এমনকি, হিন্দিতে লেখা কোনও চিঠি পেলে, তার উত্তরও সে ভাষাতেই দিতে হবে। ফাইলপত্রে নোট নিলে, তার ৩৩ শতাংশ করতে হবে হিন্দিতে। প্রতিষ্ঠানের সমস্ত ফাইলের নাম হিন্দি এবং ইংরেজিতে থাকবে। ফাইলে প্রথমে হিন্দিতে, তার পর ইংরেজিতে সে নাম লিখতে হবে। সার্ভিস বুকে যা এন্ট্রি করা হবে, তার পুরোটাও হবে হিন্দিতে। প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মে সইসাবুদও ওই ভাষাতেই করা বাধ্যতামূলক।

কেন্দ্রীয় ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সরকারি ভাষা আইনের ৩ (৩) ধারায় এই নিয়ম ১০০ শতাংশ মেনে চলতে হবে। প্রতিটি বিভাগই আগামী মাসের ৫ তারিখের মধ্যে এবং প্রতি অর্থবর্ষের শেষে এ বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে হিন্দি সেল-কে রিপোর্ট দেবে। ইতিমধ্যেই গোটা বিষয় পর্যবেক্ষণে ওই প্রতিষ্ঠানে এক জন হিন্দি বিষয়ক আধিকারিক নিয়োগ করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, হিন্দি ভাষার প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তার অনেকাংশই পূরণ করেনি আইএসিএস।

সম্প্রতি গুয়াহাটির আইআইটি-তে গবেষণাপত্র জমা দিতে গিয়ে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন বাসবেন্দু বর্মণ নামে এক পড়ুয়া। ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে শোনেন, হিন্দিতে স্বাক্ষর করতে হবে। হিন্দি লিখতে-পড়তে না জানলে পিএইচডি আটকে যেতে পারে শুনে নিজের নাম সই করতে হয়েছিল হিন্দিতেই। যা নিয়ে তিনি সরব হন নেটমাধ্যমে।

আইএসিএস-এর এই বিজ্ঞপ্তি জারির পরও নেটমাধ্যমে রীতিমতো আলোড়ন ছড়িয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ওই প্রতিষ্ঠানের একাংশ পড়ুয়া তথা রাজ্যের শিক্ষা মহলের অনেকে। একে আঞ্চলিক ভাষা ধ্বংস করার জন্য গেরুয়া শিবিরের প্রচেষ্টা বলে দাবি করেছে শাসকদল। গেরুয়া শিবিরের পাল্টা দাবি, ওই প্রতিষ্ঠান স্বশাসিত সংস্থা। তাই এ নিয়ে রাজ্য নেতাদের কোনও বক্তব্য নেই।

রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে আ়ঞ্চলিকতা খতম করার অভিযোগ তুলেছেন। ব্রাত্যর মন্তব্য, ‘‘এটা পুরোপুরি হিন্দি আগ্রাসনের চেষ্টা। বিজেপি-র যে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান তত্ত্ব রয়েছে, এটা তারই প্রতিফলন। ওরা ভারতবর্ষের আঞ্চলিকতাকে মেরে ফেলতে চায়। আঞ্চলিক ভাষাকে মেরে ফেলতে চায়।’’

যদিও গেরুয়া শিবিরের রাজ্য নেতারা বলছেন, ওই প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রের অধীন। স্বশাসিত সংস্থা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘ওই প্রতিষ্ঠান তো স্বশাসিত সংস্থা। সেখানে কী বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে না হয়েছে, তা ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপার। এ নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই।’’

আইএসিএস-এর ডিন সৌমিত্র সেনগুপ্ত গোটা বিষয়কে ‘রুটিনমাফিক’ বলেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘দীর্ঘদিন থেকেই আইএসিএস-এ হিন্দি ভাষা নিয়ে এই নিয়ম চালু রয়েছে। এটা নতুন কোনও বিষয় নয়। ফলে কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আমাদের কিছু শতাংশ কাজকর্ম হিন্দিতে করতে হয়। সম্প্রতি তা পর্যাপ্ত মাত্রায় হচ্ছিল না। ফলে ওই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।’’ আইএসিএস-এর কাজকর্মে হিন্দি নিয়ে যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য এক জন পার্টটাইম হিন্দি অফিসার রয়েছে বলেও জানালেন তিনি। তাঁর মতে, ‘‘এই বিজ্ঞপ্তি তো নতুন কিছু নয়। এই প্রসঙ্গ আগেও উঠতে পারত। এ রকম বিজ্ঞপ্তি আমাদের কাছে রুটিন বিষয়। তবে কোনও রকম রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে না ঝুঁকেই বলছি, হয়তো ভোটের সময় বলেই এ প্রসঙ্গ উঠছে।’’

কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুন না কেন, এই বিজ্ঞপ্তি নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক সুনন্দ পাত্র। তাঁর মতে, এটা আসলে ‘হিন্দি আগ্রাসন’। আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বলেন, ‘‘এটা সোজা কথায় ‘হিন্দি আগ্রাসন’। এর মানে হচ্ছে, হিন্দিতে সব কিছু করতে হবে। নচেৎ রাস্তা দেখুন।’’ কেন এমন মনে করছেন তিনি? সুনন্দর সাফ জবাব, ‘‘সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দিও রয়েছে। এবং দু’টোর মধ্যে যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার অধিকার রাজ্যের কাছে রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজকর্মের জন্য কেবলমাত্র হিন্দিকেই চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এটা আসলে অত্যাচার।’’ এর পর সরাসরি গেরুয়া শিবিরকেই আক্রমণ করেছেন সুনন্দ। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচনী ইস্তাহারে বাংলার জন্য অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জোর করে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে যে এটা ভণ্ডামির চূড়ান্ত নমুনা। ইংরেজিতে সব কাজ হচ্ছে। হিন্দিতে লেখার জন্য বাধ্য করা হলে, তা হিন্দি আগ্রাসন নয়তো আর কী?’’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ। যদিও ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আইএসিএস একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কী পরিপ্রেক্ষিতে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, তা জানি না। ওই বিজ্ঞপ্তিও দেখিনি। ফলে আমার কোনও বক্তব্য নেই।’’

তবে ওই বিজ্ঞপ্তি জারির পর এ নিয়ে আলোড়ন উঠেছে নেটমাধ্যমেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্স নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়া অরিন্দম দাশগুপ্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। কেন সরকারি কাজকর্মে হিন্দির মতো একটি ‘অবাঙালি’ ভাষা প্রাধান্য পাবে— প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আরও অনেকেই এ নিয়ে সরব হয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করা সিদ্ধব্রত দাসের মতে, এটি ফতোয়ার সমান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালির তৈরি বিজ্ঞানের পীঠস্থানে কী ভাবে বিজ্ঞানের মান বাড়ানো যায়, সমাজের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে কী ভাবে বিজ্ঞানচর্চা করা যায়, এ সব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল, কী ভাবে হিন্দি আগ্রাসনকে তরান্বিত করা যায়। কী ভাবে সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দি চাপানো যায়’। একে ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন ওই নেটাগরিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE