করোনায় প্রয়াত চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়। ফাইল চিত্র।
করোনার অভিঘাত কী ভাবে একটা পরিবারের উপরে বিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে, আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। সেই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছি আমি নিজে, আমার নাবালক সন্তান, আমার বৃদ্ধা মা— সকলেই।
আমার স্ত্রী দেবদত্তা রায় ছিলেন চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কাজের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। লকডাউনে যখন গোটা দেশ গৃহবন্দি, তখন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিক বা কর্মীদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল কর্তব্যের খাতিরে। সেই সময় ভিন্ রাজ্য থেকে ট্রেনে চেপে ফিরে আসা হাজার হাজার শ্রমিককে বাড়ি ফেরানোর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যস্ত ছিলেন আমার স্ত্রী। হাসিমুখে সেই কাজ করেছেন। তার মধ্যেই একদিন দেবদত্তা নিজেই সংক্রমিত হয়ে গেলেন।
শরীর একটু খারাপ হতে দেবদত্তা শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির সময়েই শারীরিক অবস্থা জটিল হয়। পরের দিন সকালের মধ্যেই সব শেষ। করোনার অভিশাপে দেবদত্তাকে হারিয়ে ফেললাম। আমার নাবালক ছেলে মাতৃহারা হল। তার পরে আমি, ছেলে এবং আমার মা— তিন জনই সংক্রমিত হই। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় আমাদেরও। কয়েক দিন হাসপাতালে থাকার পরে আমরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। কিন্তু দেবদত্তার অভাব পূর্ণ হবে না কোনও দিন।
এখন আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে শুনছি। আবারও চারদিকে ত্রাহি রব কানে আসছে। শুধু তাই নয়, এখন করোনা নাকি আরও শক্তিশালী! আমার মতোই আরও অনেক পরিবারকে স্বজনহারার কষ্ট বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা বলে বোঝানোর নয়। এই খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে একমাত্র জন-সচেতনতা। ডাক্তারবাবুরা বার বার বলছেন, মাস্ক ব্যবহারের কথা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন হাত ধোওয়ার কথা। নিজের, পরিবারের এবং সমাজের কথা ভেবে এটুকু কি খুব কঠিন কাজ?
কিন্তু অনেকেই নিজের ইচ্ছেমতো এ সবের তোয়াক্কা না করে চলছেন। নির্বাচনের আবহে প্রচারের মিটিং-মিছিলয়ে মাস্কহীন জনতাকে দেখছি সংবাদমাধ্যমে। তাতে সংক্রমণ আরও ছড়াচ্ছে। অন্যান্য রাজ্যের ভয়াবহতার কথাও শুনছি। সব দেখেশুনে আতঙ্কিত হচ্ছি। সহ নাগরিকদের কাছে আমার অনুরোধ, প্রশাসন যে বিধিনিষেধ আরোপ করছে, তা যেন সবাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। যে সব জায়গায় ভোট বাকি আছে, সেখানে মিটিং-মিছিলে একান্তই যেতে হলে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করে তবেই যাওয়া উচিত। মানুষ যদি নিজে থেকে সচেতন না হয়, তা হলে কিন্তু আরও বড় বিপদ আমাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে।
আর, সব নিয়ম মেনে চললে কিছু দিনের মধ্যেই নিজেদের খুব বড় ক্ষতি ছাড়াই করোনাকে আমরা বিদায় দিতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।
(লেখক করোনায় প্রয়াত চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের স্বামী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy