Advertisement
E-Paper

কেনেননি ফ্রি সরঞ্জাম, ওটি থেকে ফেরত অজ্ঞান রোগী, পিজিতে ধৃত দুই ব্যবসায়ী

সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আগাগোড়া সেঁটে ছিল চেহারাটা। অপারেশন থিয়েটারে তিনি ঢুকছিলেন-বেরোচ্ছিলেন বিনা বাধায়। মুর্শিদাবাদের শেখ নিজামুদ্দিনের আত্মীয়রা ভেবেছিলেন, হাসপাতালেরই কর্মী হবেন হয়তো।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৯
এসএসকেএম হাসপাতালে শেখ নিজামুদ্দিন। ছবি: সুমন বল্লভ।

এসএসকেএম হাসপাতালে শেখ নিজামুদ্দিন। ছবি: সুমন বল্লভ।

সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আগাগোড়া সেঁটে ছিল চেহারাটা। অপারেশন থিয়েটারে তিনি ঢুকছিলেন-বেরোচ্ছিলেন বিনা বাধায়। মুর্শিদাবাদের শেখ নিজামুদ্দিনের আত্মীয়রা ভেবেছিলেন, হাসপাতালেরই কর্মী হবেন হয়তো।

অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করাতে শুক্রবার অপারেশন টেবিলে আনা হয়েছিল নিজামুদ্দিনকে। অজ্ঞানও করা হয়েছিল তাঁকে। ওটি-র নার্স রোগীর বাড়ির লোকেদের বলেছিলেন, একটি বিশেষ ক্যাথিটার কিনে আনতে হবে। ‘সেই’ লোকটিই তখন হঠাৎ বলে উঠেছিলেন, ‘‘ওই ক্যাথিটার আমরাই কিনে নেব। এক হাজার টাকা দিন।’’ টাকা দেওয়ার পর দেখা যায়,

ওটি-র পাশেই হাসপাতালের স্টোররুম থেকে ক্যাথিটার হাতে বেরিয়ে আসছেন তিনি!

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্যের সমস্ত হাসপাতালে এখন চিকিৎসা পরিষেবা মেলে বিনামূল্যে। তা ছাড়া, যে সরঞ্জাম হাসপাতালের স্টোরেই মজুত, সেটার জন্য কেন পয়সা দিতে হবে, প্রশ্ন তুলেছিলেন রোগীর বাড়ির লোকেরা। শুনেই প্রচণ্ড খেপে লোকটি বলে ওঠেন, ‘‘খুব চর্বি হয়েছে! অপারেশন করা দেখাচ্ছি!’’ এর কয়েক মিনিটের মধ্যে অজ্ঞান অবস্থাতেই নিজামুদ্দিনকে ওটি থেকে বের করে দেন ডাক্তারবাবুরা। হাতের চ্যানেল করা জায়গা থেকে তখনও রক্ত পড়ছে!

কোনও জেলা হাসপাতাল নয়, এই ঘটনা ঘটেছে রাজ্যের সেরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম-এ। শুক্রবার সন্ধ্যায়। শনিবার হাসপাতালের সুপারের কাছে রোগীর পরিবার এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পরেই তৎপর হয়েছে প্রশাসন। নিজামুদ্দিনের পরিবারকে শাসিয়েছিলেন যিনি, রামকৃষ্ণ পাত্র নামে সেই ব্যক্তিকে এ দিনই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সঙ্গে ধরা হয়েছে আরও এক জনকে।

আর তার পরেই ফাঁস হয়ে গিয়েছে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও বেসরকারি সংস্থার আঁতাঁতের এক নতুন কাহিনি। কারণ, রামকৃষ্ণ হাসপাতালের কেউ নন। তিনি ‘ওম মেডিক্যাল’ নামে চিকিৎসা-সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া অন্য ব্যক্তির নাম সৌভিক শীল। তাঁর সংস্থা ‘জেবি হেলথকেয়ার’। দু’জনেরই দাবি, তাঁরা নিজের নিজের সংস্থার কর্ণধার। হাসপাতাল সূত্র জানাচ্ছে, গত সাত-আট বছর ধরে এসএসকেএমের ক্যাথল্যাবে এই দু’জনের রাজত্ব। কিন্তু চিকিৎসকদের প্রভাবিত করে অস্ত্রোপচার বাতিল করানো, অজ্ঞান রোগীকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে দেওয়ার মতো কাণ্ড ঘটানোর সাহস এঁরা পান কী ভাবে— সেই প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতালেও এমন ‘সিন্ডিকেট’-এর কথা শুনে চিন্তিত অনেকেই।

রাজ্যের মন্ত্রী তথা এসএসকেএম-এর রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাস বলেছেন, ‘‘এসএসকেএমে আর এ ধরনের কোনও অন্যায় বরদাস্ত করা হবে না। এর শেষ দেখে ছাড়া হবে।’’ শনিবার সুপারের কাছে রোগীর পরিবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পরেই খবর পৌঁছয় স্বাস্থ্য ভবন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে কালিম্পঙে থাকা অরূপবাবুর কাছে। তিনি সুপারকে অভিযোগটি দ্রুত খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। সেই মতো তদন্ত শুরু করেন সুপার করবী বড়াল। দুই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয় হাসপাতালের তরফে। তদন্তের কাজ শেষ হলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।

মুর্শিদাবাদের বুরওয়ান থানার কইথা গ্রামের নিজামুদ্দিন (৩৫)-এর বাড়ি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এসএসকেএমের বক্ষরোগ বিভাগের ১৫ নম্বর শয্যায় ভর্তি রয়েছেন তিনি। ফুসফুসে বিরল ধরনের টিউমার। যার জন্য রক্ত চলাচল বাধা পাচ্ছে। তাই শুক্রবার তাঁকে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগে নিজামুদ্দিনের ভাই সমনউল্লাহ জানান, বেলা ৩টে নাগাদ অপারেশন হওয়ার কথা থাকলেও সন্ধে সাড়ে ৭টায় তাঁর দাদাকে ওটি-তে ঢোকানোর তোড়জোড় শুরু হয়। তখনই এক ওটি-নার্স জানান, ‘পিগটেল ক্যাথিটার’ নেই। ওটা কিনে আনতে হবে।

এর মধ্যেই রোগীকে ওটিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সমনউল্লাহের কথায়, ‘‘ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে থাকা ওই লোকটি (রামকৃষ্ণ) ওটি থেকে বেরিয়ে বলেন, আমরাই ক্যাথিটার কিনে নেব। এক হাজার টাকা দিন। টাকা দেওয়ার পরে দেখি, তিনি স্টোররুম থেকে ক্যাথিটার নিয়ে বেরিয়ে আসছেন!’’ রোগীর ভাইয়ের দাবি, ওটি থেকে বের করে দেওয়ার পরে ট্রলিটা ঠেলে তাঁকে শয্যায় ফেরানোর দায়িত্বটুকুও নেয়নি হাসপাতালের কেউ। সেই কাজটা করতে হয়েছে আত্মীয়দেরই।

অস্ত্রোপচার না হওয়ার চিকিৎসকের নির্দেশিকা। শনিবার।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, শুক্রবার নিজামুদ্দিনের অ্যাঞ্জিগ্রাফির দায়িত্বে থাকা কার্ডিওলজি বিভাগের ইউনিটটির প্রধান ধুর্জটিপ্রসাদ সিংহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গোটা ঘটনাটির কথাই কার্যত কবুল করে নিয়েছেন। প্রবীণ এই চিকিৎসক বলেছেন, ওই দুই ব্যবসায়ীর দিনরাত ক্যাথল্যাবে পড়ে থাকা, নিজেদের সরঞ্জাম হাসপাতালের স্টোরে মজুত রাখা ও রোগীর পরিবারের কাছে বিক্রি করা— এ সব খবরই তিনি জানেন। তবে তাঁর যুক্তি, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার শুরু হওয়ার পরে দেখা যায়, বেশ কিছু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী নেই। তাই রোগীদের স্বার্থেই দু’টি সংস্থার লোকদের ক্যাথল্যাবে রাখা হত। ওঁরা ওই জিনিসগুলো চটপট এনে দিতেন।’’

কিন্তু কোনও বেসরকারি সংস্থার লোকেদের কি ওটি-তে ঢুকতে দেওয়া যায়? কোন যুক্তিতে তাঁরা সরকারি হাসপাতালের স্টোরে নিজেদের জিনিস রাখতেন? ধুর্জটিবাবুর উত্তর, ‘‘ওঁরা থাকলে অনেক মানুষের উপকার হয়। এখন প্রশ্ন উঠছে। তাই আর রাখব না।’’ অস্ত্রোপচারের সামগ্রী তো রোগীর নিখরচায় পাওয়া উচিত। হাসপাতালে যদি তা মজুত না থাকে এবং রোগীর পরিবারকে যদি তা কিনে আনতে হয়, তা হলে সেই খরচের বিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই মিটিয়ে দেওয়ার কথা। তা হলে নিজামুদ্দিনের পরিবারকে কেন তা টাকা দিয়ে কিনতে হল? ধুর্জটিবাবুর জবাব, ‘‘আমার এত কিছু নিয়ম জানা ছিল না। এর পর আর ভুল হবে না।’’ ওই দু’জন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতেন কী করে? তাঁদের কথায় কী করে এক জন রোগীকে ওটি থেকে বের করে দেওয়া হল? এ বার খানিক আমতা-আমতা করে তিনি বলেন, ‘‘সেটা একটু দেখতে হবে। তবে যে টাকাটা রোগীর থেকে নেওয়া হয়েছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’

প্রশ্নটা করা হয়েছিল রামকৃষ্ণ ও সৌভিককেও। কাঁচুমাঁচু মুখে তাঁদের উত্তর, ‘‘ভুল হয়ে গিয়েছে, আর হবে না।’’ তাতে অবশ্য কাজ হয়নি। শনিবার দুপুরে হাসপাতাল চত্বর থেকেই দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভবানীপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে গ্রেফতার করা হয় তাঁদের। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই দু’জনের কাছ থেকে এসএসকেএমের বেশ কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে।

medical negligence arrest
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy