Advertisement
১৭ মে ২০২৪
CPM

১৬ মাস আগের কংগ্রেস নিয়ে সিপিএমের মূল্যায়ন মেলেনি, ক্লাস নিতে গিয়ে কি ‘পাঠচক্রব্যূহে’ নেতারা

কংগ্রেস সম্পর্কে যা যা বলেছিল সিপিএম, তার কোনওটাই মেলেনি। দলের নেতাদের অনেকে মনে করছেন, সেই সূত্রে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, দল কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। নেতারাই বা কতটা দূরদর্শী?

CPM

রবিবার রাজ্য জুড়ে পাঠচক্র করবে সিপিএম। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৯:৩৮
Share: Save:

সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে সীতারাম ইয়েচুরির উপস্থিতি ক্ষোভ তৈরি করেছিল সিপিএমের নিচুতলায়। তার প্রেক্ষিতে সিপিএম ঠিক করেছিল, পঞ্চায়েত ভোট মিটলে ‘ইন্ডিয়া’ বোঝাতে বিশেষ কর্মসূচি নেবে সিপিএম। সেইমতোই রবিবার সারা রাজ্যে দলের প্রতিটি শাখায় গত পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক ও রণকৌশলগত লাইন ব্যাখ্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। তার জন্য একটি ১৩ পাতার নোটও প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু যে নেতারা ক্লাস নিতে যাবেন, তাঁরা খানিক ‘বিড়ম্বনায়’। সেই বিড়ম্বনা শুধু তৃণমূলের কারণে নয়। বিড়ম্বনা রাজ্যে তৃণমূলের একদা জোটসঙ্গী কংগ্রেসকে নিয়ে। কারণ, কংগ্রেস সম্পর্কে ১৬ মাস আগে দল যা বলেছিল, তা নিয়ে পার্টি মেম্বাররা প্রশ্ন তুললে কী হবে?

প্রশ্ন হল, ১৬ মাস আগে কংগ্রেস সম্পর্কে কী বলেছিল সিপিএম?

২০২২ সালের ৬-১০ এপ্রিল কেরলের কান্নুরে সিপিএমের ২৩তম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সিপিএম তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিল। তাতে কংগ্রেস দল সম্পর্কে তিনটি অনুচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়েছিল। তার মধ্যে লেখা ছিল, ‘‘কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করলেও হিন্দুত্বের আক্রমণের মুখে তারা কার্যকর মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রায়শই আপসনীতি নিয়ে চলছে। দুর্বল কংগ্রেস বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে একজোট করতে অক্ষম।’’

সিপিএমের যে নেতারা রবিবার পাঠচক্রে ক্লাস নিতে যাবেন, তাঁদের অনেকে বলছেন, গত বছর যে কংগ্রেসকে বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে একজোট করতে ‘অক্ষম’ বলা হয়েছিল, এখন তাদের কেন্দ্র করেই সব দলগুলি জাতীয় স্তরে এক হচ্ছে। এখানেই প্রশ্ন উঠতে পারে, দলের রাজনৈতিক লাইন কি আদৌ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন? দলের নেতারাও কি দূরদর্শী? অনেকের বক্তব্য, কংগ্রেসকে যে ভাবে ‘দুর্বল’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল, তা কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। কারণ, কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জয় হয়েছে। সিপিএম নেতাদের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় এমনও বলছেন যে, ‘‘আমাদের এখন কী এমন শক্তি যে, অন্য দলের দুর্বলতা-সবলতা নিয়ে আলোচনা করব!’’

২১তম পার্টি কংগ্রেসে সিপিএমের রাজনৈতিক লাইন ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেসের থেকে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে চলার। ২০১৬ সালে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতাকে সেই কারণেই মান্যতা দেয়নি সিপিএম। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে এসে পলিটব্যুরোর ডিভিশন বেঞ্চ ভর্ৎসনা করে গিয়েছিল রাজ্য কমিটিকে। তার পর অবশ্য সিপিএম সমদূরত্বের লাইন থেকে দূরে সরতে শুরু করে। গত পার্টি কংগ্রেসে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, ‘‘বিজেপি এবং কংগ্রেসকে সমান বিপদ বলে বিচার করা চলে না। যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক জোট সম্ভব নয়।’’

এই ‘যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক জোট সম্ভব নয়’ লাইনটি নিয়েও বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সিপিএমের অনেকের বক্তব্য, দলের সর্বভারতীয় সম্মেলনের পরেও বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের যৌথ কর্মসূচি হচ্ছে, ভোটে দিব্যি বোঝাপড়া হচ্ছে। তা হলে গৃহীত লাইনের কী মর্যাদা রইল, এ প্রশ্নও উঠতে পারে নিচুতলা থেকে।

উল্লেখ্য, সিপিএম আঞ্চলিক দলগুলি সম্পর্কে তাদের যে অবস্থান ঘোষণা করেছিল, সেখানে তৃণমূল সম্পর্কে দু’টি লাইন খরচ করা হয়েছিল। একটি লাইনে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তৃণমূল এক সময়ে বিজেপির সঙ্গে একই জোটে শরিক ছিল। পরের লাইনে বলা হয়েছে, ‘‘বামবিরোধী আক্রমণ বজায় রেখেছে।’’ ঘটনা হল, যে সময়ে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনের খাতায় তৃণমূল তখন জাতীয় দলের তালিকায় ছিল। পরে সেই মর্যাদা হারায় তৃণমূল। যে প্রসঙ্গে টেনে সিপিএমের এক নেতার রসিকতা, ‘‘কংগ্রেস নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি বটে। কিন্তু তৃণমূলকে আঞ্চলিক দলের তালিকায় রাখাটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল।’’

রবিবার পাঠচক্রের যে ‘নোট’ সিপিএম প্রস্তুত করেছে, তাতে দলের রণকৌশলের নির্যাস রয়েছে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট চাইছে, দলকে এটুকু বুঝিয়ে দিতে যে, তৃণমূলের সঙ্গে কোনও ‘বোঝাপড়া’ হবে না। অগস্টের শেষে মুম্বইয়ে আবার বৈঠকে বসবে ‘ইন্ডিয়া’। সেখানে মমতার পাশে আবার ইয়েচুরিকে দেখা যেতে পারে। সিপিএমের চেষ্টা, তা নিয়ে যাতে দলের নিচুতলায় বা অন্দরে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি না হয়। কিন্তু নেতাদের অনেকের আশঙ্কা— ১৬ মাস আগের নথি, পাঠচক্রের নোট এবং বাস্তবের ঘটমান রাজনীতির মধ্যে অনেক ফাঁক রয়েছে। সেই প্রশ্ন উঠে গেলে চাপে পড়তে হবে দলের শিক্ষকদের। অবশ্য পাশাপাশিই অনেকে বলছেন, দলের মধ্যে এত খুঁটিয়ে পড়ার লোক হাতেগোনা। নিচুতলায় একেবারেই নেই। সেই কারণে যা ভাবা হচ্ছে, তা হবে না। বেশির ভাগ জায়গাতেই ‘তৃণমূলের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া হবে না’ সারমর্মটুকু বুঝিয়ে দিয়েই মুড়ি-চপ-চা ঢুকে পড়বে সিলেবাসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE