শিক্ষামন্ত্রীর গাড়িতে ছাত্র আহত হওয়ার ঘটনায় উত্তাল যাদবপুরে বসে অন্য একটি দুঃসংবাদ পেয়েছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সৈকত শেঠ। কেন্দ্রের সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ বোর্ডের একটি প্রকল্পে বিদেশে গবেষণা প্রস্তাবটি হঠাৎ কেঁচে গিয়েছে বলে তাঁকে জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বের সেরা দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় টানা পাঁচ বছর নিজের জায়গা ধরে রাখা দেশের প্রথম সারির বিজ্ঞানী সৈকত বলেন, “আমায় বলা হয়েছে, গবেষণা কর্মসূচিটি হঠাৎ বাতিল করে ‘অনুসন্ধান ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ বলে একটি নতুন কর্মসূচি চালু হচ্ছে!” সৈকতের কথায়, “ইদানীং এমন গবেষণার কর্মসূচি বাতিলে আমরা ঘন ঘন ভুগেই চলেছি।”
যেমন ১০০ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান বা রুসা প্রকল্প মাঝপথে বন্ধ হওয়ার ধাক্কা যাদবপুর এখনও কাটাতে পারেনি। এর ফলে অতিমারি পর্বেই অন্তত শ’তিনেক গবেষক, গবেষণা সহায়কের জীবিকা সঙ্কট দেখা দেয়। এমনকি শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে যাদবপুরের গাঁটছড়ায় কিউবেটর সেন্টার বা বিজ্ঞান গবেষণার বেশ কিছু সরঞ্জাম কেনা থেকে নতুন পরিকাঠামো তৈরিও থমকে গিয়েছে। ইউজিসি-র চেয়ারম্যান এম জগদেশ কুমারের কাছে এ পর্যন্ত এই প্রকল্প বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে সদুত্তর মেলেনি।
ইংরেজির অধ্যাপক ও যাদবপুরের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস (এসসিটিআর)-এর অধিকর্তা অভিজিৎ গুপ্ত বলছিলেন, “ইমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান ‘শব্দকল্প’ তৈরির কাজটি যাদবপুরের গ্লোবাল প্রাক্তনী ফাউন্ডেশনের সাহায্যে চলছে। ভাষার প্রতিটি শব্দের ইতিহাস ধরে এমন ডিজিটাল অভিধান একটি বিরল উদ্যোগ, যা ২০২৮-এর একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পূর্ণ করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে।”
অনেকেই জানেন না, নানা ধরনের ডিজিটাল আর্কাইভ বা মহাফেজখানা নির্মাণে ব্রিটিশ লাইব্রেরির এনডেঞ্জার্ড আর্কাইভ প্রোগ্রামে দুনিয়ার পাঁচটি নোডাল সংস্থার একটি যাদবপুরের এসসিটিআর। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজবিদ্যার মেলবন্ধনে যাদবপুরের এই স্কুল গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডিজিটাল নথি তৈরির শরিক। প্রকাশনা ও সারস্বত চর্চায় যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেসের মতো একটি সংস্থাও দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল। মুরাকামি, সার্ত্র, দান্তে, মেকিয়াভেলি-সহ দেশ-বিদেশের সাহিত্য মূল ভাষা থেকে বাংলায় তর্জমার প্রকল্পে দুই বাংলায় অগ্রণী যাদবপুরই। অভিজিৎ বলছিলেন, “নানা জায়গা থেকে রেস্ত বা বিদেশি অনুদান জোগাড় করে প্রকাশনা বা মহাফেজখানা তৈরির নানা প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।”
বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর স্ট্যানফোর্ড তালিকায় যাদবপুরের অধ্যাপকদের সংখ্যা প্রায়শই আইআইটিগুলিকেও টেক্কা দেয়। এই তালিকার অন্যতম মুখ সৈকত যাদবপুরেরই প্রাক্তনী। তিনি বলছিলেন, “মেধায়, উদ্ভাবনী ক্ষমতায় কারও থেকে কম নয় যাদবপুর, কিন্তু পরিকাঠামোয় পিছিয়ে রয়েছি। যাদবপুরে প্রশাসনিক সঙ্কট না কাটলে এই খামতি দূর হওয়ার নয়!” সৈকতের ছাত্রদেরই কয়েক জনকে গবেষণার ‘ডেটা কালেকশনে’ এ বার আইসার, ভোপালে যেতে হবে। সেখানে তাঁরা যাদবপুরের এক প্রাক্তনীর তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন। কারণ, তথ্য সংগ্রাহক ওই দামি যন্ত্র যাদবপুরে নেই।
“শুধু পরিকাঠামোর অভাব নয়, বৈষম্যেরও শিকার যাদবপুর”, বলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (জুটা)-র সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায়। তাঁর কথায়, “দু’বছর আগে ইনস্টিটিউট অব এমিনেন্স বা দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত হয়েও টাকার অভাবে যাদবপুর বাদ পড়ে। রাজ্য সরকার ২০০০ কোটি টাকা দিতে পারেনি, তাই কেন্দ্রও তার ভাগের টাকা দেয়নি। অথচ জিয়ো বিশ্ববিদ্যালয় ওই তালিকায় ঢুকেছিল! তার মানে কি টাকাই উৎকর্ষের মাপকাঠি? টাকা না দিলেও মর্যাদাটুকু অন্তত কেন্দ্র দিতেই পারত।”
আইআইটি, আইআইএসসি-র মতো প্রতিষ্ঠানের থেকে ঢের কম অনুদানে পুষ্ট দেশের প্রথম দু’-একটি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম যাদবপুর তবুও উৎকর্ষ সাধনার অসম লড়াইয়ে শরিক। শিক্ষাবিদদের একাংশের মতে, কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসক দলের রাজনীতি যাদবপুরের মাটিতে দাঁত ফোটাতে পারে না বলেই এই প্রতিষ্ঠান অনেকের বিষ নজরে। কেন্দ্র স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগে দেরি করছে। রাজ্যও খরচ কমাচ্ছে। যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতির মধ্যে কিছু উগ্রতা দেখা দিলেও রাজ্যের শাসক দলের ওয়েবকুপার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সমস্যা বাড়াচ্ছে বলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত অনেকের অভিমত। জুটা-র পার্থপ্রতিম বলেন, “যাদবপুরে প্রশাসনের নানা স্থায়ী পদাধিকারী বসানো ও গণতান্ত্রিক কাঠামো ফেরানোর দাবি সঙ্গত। কিন্তু যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতিও সংযত হওয়া কাম্য। আমরা বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদের পরীক্ষা, ক্লাসে ফিরতে বলছি। উগ্র রাজনীতির জন্য যাদবপুরের ভাবমূর্তি খারাপ হলে সবারই ক্ষতি।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)